জেন্ডার (Gender) ও সেক্সের (sex) মধ্যে পার্থক্য


নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কে বোঝানোর জন্য জেন্ডার শব্দটি ব্যবহার করা হয় নারী ও পুরুষের মধ্যে জৈবিক পার্থক্য (Biological difference) রয়েছে, সেক্স শব্দ দ্বারা তা চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সেক্স শব্দটি সবার নিকট
পরিচিত। এর নানা অর্থ আছে। তবে মূল অর্থটি জীববিজ্ঞান এর সঙ্গে (Biology) জড়িত। জীব বিজ্ঞানের সুত্র অনুসারে নারী পুরুষের মধ্যে কিছু জৈবিক পার্থক্য (Biological) আছে। যেমন নারী সন্তান ধারন করে, পুরুষ করেনা, যৌন মিলনে পুরুষ সক্রিয়, নারী তুলনামূলকভাবে কিছুটা নিস্ক্রিয়; পুরুষের দাঁড়ী গোঁফ হয়, নারীর হয়না, সন্তান ধারন ও লালনের জন্য নারীর কতিপয় বৈশিষ্ট্য আছে, পুরুষের সেগুলো নেই। নারী ও পুরুষের এই শারীরিক পার্থক্য এটি সামাজিক ভাবে সৃষ্ট নয় বরং জৈবিক। নারী ও পুরুষের এই জৈবিক পার্থক্য বুঝাতেই সেক্স শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভিন্নতার জন্য জাতির দুই অংশের একটি পুরুষ অন্যটি নারী। সেক্স অর্থ নারী-পুরুষ জৈবিক ভেদ। জৈবিক কারনে কেউ পুরুষ হয়ে জন্মায়, কেউ নারী হয়ে জন্মায়। নারী ও পুরুষের সেক্স পার্থক্য নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যখন নারী ও পুরুষের এই জৈবিক পার্থক্যের দোহাই দিয়ে পুরুষের মধ্যে কতিপয় বৈশিষ্ট্য আরোপ করে সেগুলোকে পুরুষ সুলভ বৈশিষ্ট্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং নারীর মধ্যে কতগুলো বৈশিষ্ট্য আরোপ করে সেগুলোকে নারীসুলভ (feminine) বৈশিষ্ট্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য গুলোর সঙ্গে (Biological) সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগ নেই; সমাজ এই বিভেদমূলক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে পুরুষত্ব এবং নারীত্বর ধারণার জন্ম দিয়েছে। পুরুষ ও নারীর সেক্স ভেদাভেদকে ভিত্তি করে সমাজ  নারী ও পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট, সমাজ নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ককেই জেন্ডার বলা হয়ে থাকে। নারী ও পুরুষের জৈবিক পার্থক্য অর্থাৎ সেক্স পার্থক্য। অপর পক্ষে পুরুষত্ব এবং নারীত্ব সমাজ বিনির্মিত পার্থক্য ওঠা নারী-পুরুষের পরিচয়, আচরন, সামাজিক দায়-দায়িত্ব বা ভূমিকা আর সেক্স বৈশিষ্ট্য পার্থক্য। জেন্ডার নারী-পুরুষের কাজের মাঝে কোন কাজ করেনা কিন্তু সেক্স নারী-পুরুষের  কাজের মাঝে পার্থক্য করে।
জেন্ডার প্রত্যয়টি বা নারী শব্দের চেয়ে ব্যাপক ও অধিকতর বস্তুধর্মী। কারণ জেন্ডার শুধু নারীকে নয়, নারী ও পুরুষ উভয়কে বোঝায়। প্রতিটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ জেন্ডার নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা বা ক্ষমতার কমবেশী সর্ম্পকে ইঙ্গিত করে না। ফলে জেন্ডার বস্তুনিষ্ঠ। জেন্ডার নারী ও পুরুষের জৈবিক ও সামাজিক পার্থক্যকে যুক্তি সহকারে চিহ্নিত করে। নারী ও পুরুষের জৈবিক ভূমিকার সঙ্গে সামাজিক ভূমিকার প্রভেদ তুলে ধরে নারী ও পুরুষের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক সম্পর্ক গুলোকে সামনে নিয়ে আসে এবং সম্পর্ক গুলোর মধ্যে কোন গুলো জীববিজ্ঞানের সূত্রদ্বারা নির্ধারিত এবং কোনগুলো সামাজিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট তা সুষ্পষ্টরূপে প্রতিদান করে। এভাবে জেন্ডার প্রত্যয় জীববিজ্ঞানের ভিত্তিতে নারীকে পুরুষের অধিনতাপাশে আবদ্ধ করার সামাজিক প্রক্রিয়ার অসারতা প্রমান করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সেক্স ভূমিকা ও জেন্ডার ভূমিকার তফাৎ বিশ্লেষণ করা বাঞ্ছনীয়। নারী সন্তান ধারণ করে, এই নারীর ভূমিকা সেক্স ভূমিকা। জীববিজ্ঞানের নিয়মে একমাত্র নারী সন্তান ধারণে সক্ষম, পুরুষ এখানে অক্ষম। অপরপক্ষে সমাজ সন্তান পালনের দায়িত্ব এককভাবে সমাজ সন্তান পালনের দায়িত্ব এককভাবে নারীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে এই যুক্তিতে যে সন্তান নারীর জৈবিক ভূমিকা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা নয়, পুরুষ ইচ্ছা করলে সন্তান পালন করতে পারে। সন্তান প্রতিপালনের কর্মকাণ্ডে পুরুষের উপর জৈবিক কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। সন্তান প্রতিপালনের নারীর উপর জীববিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই সন্তান প্রতিপালন নারীর সেক্স ভূমিকা নেই নয়। এই ভূমিকা নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া সমাজসৃষ্ট ভূমিকা অর্থাৎ সন্তান প্রতিপালন নারীর জেন্ডার ভূমিকা। নারী গৃহে ঘর-গৃহস্থলীর কাজ করবে। পুরুষ অফিস, কলকারখানা কিংবা ক্ষেত- খামারে কাজ করে। নারী গৃহ কর্মেও বিনিময়ে কোন আর্থিক সুবিধা নেই, পুরুষ অফিস, কলকারখানা কিংবা ক্ষেত-খামারে কাজের বিনিময়ে আছে আর্থিক রোজগার। নারী ও পুরুষের মধ্যে এই কর্মবিভাজন এর কোন জৈবিক ভিত্তি নেই। জীববিজ্ঞানের এমন কোন বাধা ধরা নিয়ম নেই যে, পুরুষকে অফিসে কাজ করতে হবে এবং নারীকে গৃহকর্ম করতে হবে। এই কর্মবিভাজন সমাজ সৃষ্টি করেছে। সমাজ বিনির্মিত নারী-পুরুষ কর্ম বিভাজন জেন্ডার কর্ম বিভাজন, সেক্স কর্ম বিভাজন নয়। ইচ্ছা করলেই এই কর্ম বিভাজন বদলে দেখা যায়। পুরুষকে যদি ঘরের রান্না-বান্না কাজে নারীকে যদি অফিস-কলকারখানায় কিংবা খেত-খামারের অর্থকারী কাজে নিয়োগ করা হয়, তাহলে জীববিজ্ঞানের নিয়মে কোন ব্যতয় ঘটবে না। নারী-পুরুষর সেক্স ভূমিকার প্রকৃতির অমোঘ বিধান দ্বারা নির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয়; অপরপক্ষে জেন্ডার ভূমিকা সমাজ সৃষ্ট এবং পরিবর্তনীয়। জেন্ডার ভূমিকা নারী নির্যাতন, অধস্তন, অবস্থা এবং পুরুষের প্রাধান্যর কারণ ও বহিঃপ্রকাশ। তাই নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য ও সমতা আনয়নের লক্ষ্যে, নারী নির্যাতন নির্ম’ল করতে এবং নারীকে পুরুষের সঙ্গে সমতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে এ ধরনের জেন্ডার ভুমিকায় পরিবর্তন আনা দরকার। যেমনঃ মহিলারা সন্তান লালন পালনকারীর পরিবর্তে আয় উপার্জনকারী হতে পারে এবং পুরুষেরা আয় উপার্জনকারী পরিবর্তে সন্তান লালন পালনকারীর হতে পারে। এটা নির্ভর করবে নারী-পুরুষর যোগ্যতা তৈরি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার উপর।
কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশে নারীর পেশা বলতে বোঝাতে গতানুগতিক দুটি পেশা শিক্ষকতা ও নার্সিং যা সমাজ পদত্ত চিরাচায়িত নারীর সেবামূলক ভূমিকার বর্ধিতর সংরক্ষণ মাত্র। অর্থাৎ বাচ্চাদের দেখাশুনা করা আর রোগীদের সেবা করা। নির্দেশক একটি অনুশীলন পত্র নিম্মে প্রদত্ত হলো। আপনি চিহ্নিত করার চেষ্টা করুন এর মাঝে কোনগুলো জেন্ডার এর সাথে সম্পর্কযুক্ত (সামাজিক/সাংস্কৃতিক) এবং কোনগুলো সেক্স বা লিঙ্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত (দৈহিক বা শারীরিক পার্থক্য)
মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান; 
  • ছেলেদের  চেয়ে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠার প্রবণতা দেখা যায়;
  • বাংলাদেশের রিক্সাচালক ছেলেরা;
  • মেয়েরা সাধারণত ছেলেদের  চেয়ে কম খায়;
  • বাংলাদেশের মেয়েরা সাধারণত সাইকেল চালায় না;
  • ছেলেরা মেয়েদের  চেয়ে কম কাঁদে;
  • বাংলাদেশের ছেলেরা মেয়েদের  চেয়ে গনিত ও বিজ্ঞানে ভাল করে ;
  • বাংলাদেশের এস.এস. সি পাশের হার  মেয়েদের  চেয়ে  ছেলেদের  বেশি;
  • মায়ের শিক্ষা বাবার শিক্ষার চেয়ে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উপর বেশি প্রভাব ফেলে;
  • বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ ছেলেদের  চেয়ে মেয়েরা কম পায়;
  • ছেলেদের  দাঁড়ি আছে;
  • শিখ পুরুষদের দাঁড়ি আছে;
  • শিখ ছেলেরা মাথায় পাগড়ি বাধে;
  • বহু মেয়ে রক্ত সল্পতায় ভোগে;
  • দরিদ্র দেশে/সমাজে/ পরিবারে ছেলেদের শিক্ষাকে মেয়েদের শিক্ষার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়;
  • মেয়েদের  সাধারণত ছেলেদের  চেয়ে বড় চুল হয়;
  • ছেলেদের  সাধারণত মেয়েদের  বড় হয়;
  • ছেলেরা আয় উপার্জনকারী, মেয়েরা সেবাদানকারী;
  • মা শিশুকে পেটে ধরে;
সেক্স ও জেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য
সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ
জেন্ডার বা সামাজিক লিঙ্গ
জৈবিক লিঙ্গ নারী ও পুরুষের জৈবিক  বিশেষত্ব।
জেন্ডার সংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে নির্ধারিত
প্রাকিতিকভাবে নির্ধারিত যা ব্যক্তি জন্মগতভাবে লাভ করে।
বিভিন্ন সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, যেমন-পরিবার,সরকার,জনগোষ্ঠী, স্কুল, মিডিয়া ইত্যাদি স্মমিলিতভাবে জেন্ডার সৃষ্টি করে।
জৈবিক লিঙ্গ স্থান-কাল নির্বিশেষে অপরিবর্তিত থাকে।
জেন্ডার সামাজিকভাবে নির্ধারিত হওয়ার ফলে সংস্কৃতিকভেদে ও সময়ের সাথে সাথে এর  পরিবর্তন ঘটে।

তথ্য: 
তথ্য আপা প্রকল্প

0/Post a Comment/Comments