মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। কেননা মানুষ সর্বদাই চায় একটি সমাজবদ্ধ জীবন। আর এ সমাজে টিকে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি দায়িত্ব হলো পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা। যোগাযোগ ছাড়া সব কিছুই যেন অর্থহীন। তাই স্কুল অথবা চাকরি জিবনে আমাদের দরখাস্ত লিখতেই হয়।দরখাস্ত-লেখার-নিয়ম আজ উপস্থাপন করা হলো।
আজকের এই মানব সভ্যতা বিকাশের পূর্বে মানুষ গাছের ছাল কিংবা পাতায় লিখে যোগাযোগ রক্ষা করা হত। সেখান থেকেই সম্ভবত এই ‘পত্র’ নামের উৎপত্তি। ‘পত্র’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘চিহ্ন’ বা ‘স্মারক’।
বর্তমানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। এ ‘পত্র’ই বর্তমানে আমরা চিঠি অর্থে ব্যবহার করি। যার দ্বারা আমরা আমাদের মনের ভাব বিনিময় করি। যদিও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হাতে লেখা চিঠির প্রভাব এখন আর তেমন নেই। এখন সে স্থানে জায়গা করে নিয়েছে ইলেকট্রনিক মাধ্যম (মেসেজ, ই-মেইল)।
পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে চিঠি পত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
তবে শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, আমরা অফিস আদালতেও যোগাযোগ রক্ষা করি। আর ব্যক্তিগত প্রয়োজনের বাইরে আমরা যখন চিঠি লিখি, সেগুলো হচ্ছে আবেদনপত্র বা আপ্লিকেশন। আমাদের দৈনন্দিন নানান কাজে বিভিন্ন সময় আমরা আবেদনপত্র লিখে থাকি।
কিন্তু এই চিঠি বা আবেদনপত্র লেখারও অনেক নিয়ম রয়েছে। হয়তো আমরা অনেকেই জানি না কিভাবে চিঠি/দরখাস্ত লিখতে হয়। তাই নিয়ে আজকের এ আলোচনা।
সাধারণত দুই রকমে চিঠি লেখা হয়। যথা—
1. ব্যক্তগত ও পারিবারিক
2. ব্যবহারিক বা বৈষয়িক।
তবে ব্যাপকভাবে পত্রকে ৭ ভাগে ভাগ করা যায়।
1. ব্যক্তিগত পত্র
2. আবেদনপত্র
3. সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য পত্র
4. মানপত্র বা অভিনন্দনপত্র
5. বাণিজ্যিক পত্র
6. নিমন্ত্রণপত্র
7. স্মারকলিপি বা অভিযোগপত্র।
পত্র লেখার কিছু কলা-কৌশল ও নমুনার জন্য একটি আবেদনপত্র দেওয়া হলো। সাধারণ মানুষ তথা শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠের অংশ হিসাবে এটা দেখতে পারো।
পত্র লিখবার সময় নিম্ন লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক:
- পত্র সাধারণত চলিত ভাষায় লেখা উচিত।
- পত্রের লেখা সুন্দর ও পরিষ্কার হওয়া দরকার।
- ভাষা সংক্ষিপ্ত ও সহজ হওয়া দরকার।
- যাকে যেরূপ পত্র লেখা উচিত, এর ব্যতিক্রম যেন না হয়।
- সর্ব প্রকার বাহুল্য বর্জন করা দরকার।
- বিষয়বস্তু গোছালো হওয়া দরকার।
- ঠিকানা সঠিক ভাবে লেখা দরকার। [নতুবা ডেড লেটার হিসাবে চিহ্নিত হয়।]
পত্র লেখার আরও কিছু বিষয়াদি:
- মুসলমানরা পত্র শীর্ষে বা পত্রের উপর দিকে এলাহি ভরসা বা আল্লাহ ভরসা ছাড়াও আরবি বর্ণেও কিছু শব্দ লেখে। যেমন: ৭৮৬। আর হিন্দুরা God is kind, ঈশ্বর বা ভগবান দয়ালু কিংবা শ্রী শ্রী হরি সহায় লিখে থাকে।
- মুসলমানরা বড়দের ও গুরুজনদের সম্ভাষণে পাক জনাবেষু, জনাব, বাদ আরজ এবং হিন্দুরা শ্রীচরণ কমলেষু বা ভক্তি ভজনেষু ব্যবহার করে অথবা উভয়ের বেলাতেই ‘শ্রদ্ধেয়’ ব্যবহার করে।
- মুসলিম রীতিতে ছোটদের বেলায় দোয়াবরেষু, দোয়াবর এবং হিন্দু রীতিতে প্রীতি ভজনেষু ব্যবহার করা হয়। অথবা উভয়ের ক্ষেত্রে ‘স্নেহের’ ব্যবহার করা হয়।
- বন্ধু-বান্ধবের নিকট হিন্দু-মুসলমান সবাই প্রিয়, বন্ধুবর, প্রিয়বর, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় বান্ধবী, প্রিয়তম, প্রিয়তমা ব্যবহার করে।
- আবেদনপত্রে, নিমন্ত্রণপত্রে, অভিনন্দনপত্রে ও মানপত্রে পরিচিত-অপরিচিত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার নিকট হিন্দু-মুসলমান সবাই সবিনয় নিবেদন, মহাশয়-মহাশয়া, জনাব-জনাবা লিখে থাকে।
- সমাপ্তি পর্বে ছোটরা লিখবে স্নেহের খাদেম, আরজগোজার (মুসলিম রীতিতে) এবং সেবক, প্রণত, স্নেহের, আশিষ প্রার্থী (হিন্দু রীতিতে) আর বড়রা লিখবে আশীর্বাদক, শুভাকাঙ্ক্ষী ইত্যাদি। বন্ধু-বান্ধবগণ লিখবে গুণমুগ্ধ, প্রীতিমুগ্ধ, প্রীতিসিক্ত ইত্যাদি। দরখাস্ত কিংবা আবেদনপত্রে নিবেদক, বিনীত, অনুগত, বিশ্বস্ত ইত্যাদি।
- প্রাপক গুরুজন হলে নামের পূর্বে মুসলমানদের লিখতে হয় জনাব, জনাবা, এবং হিন্দুদের লিখতে হয় পরম পূজনীয়, মহাশয়-মহাশয়া ইত্যাদি। প্রাপক কনিষ্ঠ হলে লিখতে হয় দোয়াবর কিংবা স্নেহাস্পদ।
- পিতা-মাতা, চাচা, মামা, বড় ভাই, বড় বোন, ফুফুর বেলায় সম্ভাষণ ও কুশল জ্ঞাপন প্রায় একই হয়। শুধু মুল বক্তব্য ভালভাবে গুছিয়ে লিখতে হয়। সমাপ্তি বক্তব্যও প্রায় একই।
চলুন আবেদন পত্রের একটি নমুনা দেখি—(দরখাস্ত নমুনা)
ধরা যাক, বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো ফল লাভ করার জন্য তোমরা পরীক্ষার্থীরা স্কুলে অতিরিক্ত পাঠের ব্যবস্থা চাও। এ প্রার্থনা জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বরাবরে একটি দরখাস্ত লিখ। আশা করি এই দরখাস্ত নমুনা সকলের কাজে লাগবে।
বর্তমানে আবেদন/দরখাস্ত লিখনে তারিখ বাম পাশে সবার উপরে ও ভদ্রোচিত বিদায় সবার নিচে বামপাশে মার্জিন বরাবরে লিখতে দেখা যায় এবং পত্রের ছয়টি অংশই বাম মার্জিন বরাবরে লেখার প্রচলন চলমান।
নমুনা
১। তারিখ: ১২/১০/২০১৮
২। শিরোনাম/ প্রাপক
(ঠিকানা সংবলিত) বরাবর,
প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষ মহোদয়
……………………………………… বিদ্যালয়।
৩। মূল কথা/ বিষয় : অতিরিক্ত পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন
৪। সম্ভাষণ মহোদয়/ মহাত্মন/ জনাব,
৫। আবেদনের গর্ভাংশ: সবিনয় বিনীত নিবেদন আমরা আপনার বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীবৃন্দ। আগামী ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি। বর্তমান কঠিন প্রতিযোগিতার সময়। এমতাবস্থায় ভালোফলের জন্য ভালো প্রস্তুতি প্রয়োজন। তাই বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি বিশেষ অতিরিক্ত পাঠ এর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আপনার সমীপে প্রার্থনা জানাচ্ছি।
অতএব, মহোদয় ঐকান্তিক প্রার্থনা, আমাদের অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতি নিয়ে অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণে জনাবের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
৬। ভদ্রোচিত বিদায়/ বিদায় সম্ভাষণ (নাম ও স্বাক্ষরসহ) নিবেদক
আপনার বাধ্যগত শিক্ষার্থীবৃন্দ
………………………………….. বিদ্যালয়/স্কুল/পাঠশালা
উপরের এই দরখাস্ত নমুনা সকলের সুবিধার্থে দেয়া হলো। তবে বাজারে দরখাস্ত নমুনা দিয়ে অনেক বাংলা বই পাওয়া যায় আপনি আরও বিস্তারিত চাইলে বই সংগ্রহ করে পড়তে পারেন।
ব্যক্তিগত পত্র
বাবার কাছে মেয়ের চিঠি
০২.১০.২০১২
সদর রোড, বরিশাল
শ্রদ্ধেয় বাবা,
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম নেবেন। মাকেও আমার সালাম জানাবেন। ফারজানা ও ছোট্টভাই রিয়াদের প্রতি রইল অশেষ স্নেহ।
সেদিন বাস স্টপে আপনার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ভালোভাবেই বরিশাল এসে পেীছেছি । যদিও সারা পথ বাড়ির কথা ভেবে কী– যে মন খারাপ লেগছে। আগামি ১০ই নভেম্বর থেকে আমাদের প্রাক– নির্বাচনী পরীক্ষা। তাই পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি । বাবা, আপনার স্বপ্ন আকাঙ্খার কথা আমার মনে আছে । আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন ,যেন আমি ভাল ফল করে আপনার মুখ উজ্জ্বল করতে পারি । মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারি।খোদার অশেষ কৃপায় আমি ভালো আছি।আপনি আমার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেবেন । চিঠিতে আপনাদের খবর বিস্তারিত জানাবেন ।
ইতি
আপনার স্নেহধন্য
শিমু
Post a Comment