বই রিভিউ: হারকিউলিস রহস্য
জায়েদ আল মাহমুদ
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ধর্ষণ। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে ধর্ষণের নানা ঘটনার খবর। গ্রামে কিংবা শহরে থেকে শুরু করে,বাড়িতে কিংবা রাস্তায়, অফিসে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনকি চলমান বাসে পর্যন্ত ঘটে চলেছে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা। কেউ যেন নিরাপদে নেই। এখানে শিক্ষক কতৃক ছাত্রী ধর্ষিত হচ্ছে,স্বামীর সামনে স্ত্রী ধর্ষিত হচ্ছে, এমনকি সুসংরক্ষতি এলাকায় পর্যন্ত নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে।
সমসাময়িক এই বিষয় নিয়ে লেখক এবার কলম ধরেছেন। লেখকের এই উপন্যাসের থিম হলো ধর্ষণ। বলতে গেলে, উপন্যাসটা কুমিল্লার সেনানিবাসে ধর্ষিত তনুকে দেয়া লেখকের ছোট্ট উপহার। মাঝে মাঝে মাঝরাতে লেখক তনুকে স্বপ্ন দেখতেন। এমন একদিন তনুকে স্বপ্নে দেখার পর লেখক সিদ্ধান্ত নিয়ে তনুকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। অবশেষে লেখক তার কলমের ক্ষমতা দিয়ে লিখে ফেললেন অসাধারণ একটা উপন্যাস। এটি লেখকের গোয়েন্দা কবি সাহেব সিরিজের তৃতীয় বই।
কাহিনি সংক্ষেপ-
সারা দেশে গত দেড় মাসে তিনটা চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। তিনটা খুন একই কায়দায় করা হয়েছে। ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গ ফালা ফালা করে কেটে হত্যা করা হয়েছে। যে তিনজন খুন হয়েছে তারা সবাই ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত।সবচেয়ে রহস্যজনক ব্যাপার হল, প্রত্যেকটা লাশের পাশে একটা করে সাদা করে চিরকুট পাওয়া গেছে এবং হারকিউলিস নামে দায় স্বীকার করা।
পুলিশ দিশেহারা। তারা কোন তথ্যই দিতে পারছে না।
এই হারকিউলিস সারা দেশে এখন ভাইরাল হয়ে গেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের উপর চাপ পড়ে হারকিউলিস রহস্য উদঘাটনের। তারা খুঁজতে ব্যর্থ হলে গোয়েন্দা বিভাগে চিফ আকরাম আহমেদের পরামর্শে লেখক কবি সাহেবের উপর দায়িত্ব পড়ে হারকিউলিস রহস্য উদঘাটনে। যিনি ইতিমধ্যে নিজের আগ্রহে চাঞ্চল্যকর দুইটা কেসের সমাধানও করেছেন।
এরপর সহকারী তামিম ও রিমিকে নিয়ে শুরু কবি সাহেবের হারকিউলিস নামক অদৃশ্য এক খুনির পিছনে ছুটা। তার খুনির মোটিভও স্পষ্ট৷ ধর্ষণের প্রতিশোধ অথবা শাস্তি। কেউ একজন ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে নেমেছে। কিন্তু কেন? ধর্ষণের প্রতিশোধ সে নিতে চায় কেন? এতে তার কী লাভ? সে কি ধর্ষিতার পরিবার? নাকি বাইরের কেউ? অথবা মানসিক বিকার কোন সিরিয়াল কিলার? যার নেশা মানুষ খুন করা। কিন্তু এইক্ষেত্রে সে বেছে বেছে ধর্ষকদের খুন করে যাচ্ছে। আচ্ছা খুনি কি একজন নাকি একাধিক? হারকিউলিস তো একের অধিকও হতে পারে।
অজানা সেই অধ্যায়ের রহস্য জানতে পড়তে হবে মুহাম্মাদ ইব্রাহিমের হারকিউলিস রহস্য....
পাঠ পর্যালোচনা -
বলতে গেলে বইটা এক বসাতে পড়ে ফেললাম। এত এত রহস্য যে আমার পক্ষে শেষ না করে উপায় নেই।
উপন্যাসটা শুরু হয়েছে কবি সাহেবের পত্রিকা পড়ার মধ্য দিয়ে। সময়ের সাথে সাথে যেন পত্রিকা পড়ার আগ্রহ মানুষ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে৷ কিন্তু পত্রিকা পড়ার আলাদা একটা মজা ও গুরুত্ব রয়েছে লেখক বেশ দারুণভাবে এটা ফুটিয়ে তুলেছেন৷
দ্বিতীয় অধ্যায়ে, লেখক বর্তমান পুলিশের একটা দিক খুব সাহসিকতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমি মনে করি, এটা পুলিশের একটা বাজে দিক, জনগণের সাথে প্রতারণার সামিল। অপরাধীকে ধরতে না পারলে অথবা অপরাধীকে বাঁচাতে অন্য কোন ব্যক্তিকে অপরাধী সাজিয়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা। লেখকের এই সাহসিকতাকে আমি সাধুবাদ জানাই৷
ষষ্ঠ অধ্যায়ে, ধর্ষণে যে শুধু ধর্ষিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা না, স্বপ্ন ভেঙে যায় একটা পরিবারের। ধর্ষণে একটা পরিবারের মানুষদের কী অবস্থা হতে পারে লেখক সেই দিকটা খুব অকপটে বর্ণনা করেছেন।
সপ্তম অধ্যায়ে, কবির মনে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কেসটা তিনি ছেড়ে নেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছিলেন৷ কিন্তু দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ তাকে আবার তদন্তে ফিরে এনেছেন।
অষ্টম অধ্যায়ে, কবি সাহেবের সহকারী তামিমের খাওয়ার প্রতি দুর্বলতার দিকটা পজেটিভলি নেওয়ার দিকটা বেশ ভালো লেগেছে। এখানে বলা হয়েছে- 'পৃথিবীতে সবাই খাওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। খেতে পারাও মহান আল্লাহ তা'য়ালার একটি বিশেষ নেয়ামত। একেকজন মানুষকে আল্লাহ একেক রকম রিজিক দান করেছেন। এমন হাজার মানুষ আছে, যার অঢেল টাকা-পয়সা রয়েছে। অথচ, ডাক্তার তাকে তিনবেলা ভুট্টার সুপ ছাড়া কিছুই খেতে দেয় না। বেঁচে থেকে যদি খাদ্যগ্রহণের আনন্দ থেকে বঞিত হয়ে, পৃথিবীতে এর চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে! এই বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না।
নবম অধ্যায়ে, কবি সাহেব বলেছেন- ' আমি কারো হয়ে কাজ করছি না। আমি কাজ করছি সত্যের হয়ে। একজন গোয়েন্দা যখন কাজ করে তখন সে সত্যের হয়ে কাজ করে। সত্য যদি আমার সামনে আমার পিতাকেও অপরাধী হিসেবে তুলে ধরে, তাহলেও আমি সত্যের পথেই থাকবো ইনশাআল্লাহ্। কবি সাহেবের এই দিকটা আমাকে বেশ ভাবনাতাড়িত করেছে।
এছাড়া, এই অধ্যায়ে কবি সাহেবের লাল আকাশ দেখে নস্টালজিক হওয়ার দিকটা ছিল অসাধারণ। এটা কবি সাহেবকে ছোটবেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়৷ কবি সাহেবের সাথে সাথে আমিও শৈশবের সেই হারানো সুন্দর স্মৃতিতে চলে গিয়েছিলাম। এই অধ্যায়ে কবি বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে আক্ষেপও করেছেন।
দশম অধ্যায়ে, লেখক ধর্ষকদের পরিবারের প্রতি ঘৃণিত একটা দিক ফুটে তুলেছেন। কোন এক বিচিত্র কারণে ধর্ষকরা বেশিরভাগ সময় প্রতিভাশালী পরিবারের সন্তান হয়ে থাকে। তবে সন্তানদের প্রতি সঠিক দায়িত্বহীনতা কি সন্তানদের এই ধরনের ঘৃণিত কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে না? তাইতো এই অধ্যায়ে কথোকপথনে চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
এগারো অধ্যায় থেকে উপন্যাসের কাহিনি অন্য দিকে মোড় নেয়, যা পাঠকদের মনে অন্যরকম ধ্রুম্রজাল সৃষ্টি করবে। পাঠকরা এখানে চমকে যাবেন। কবি সাহেব এখানে হারকিউলিস রহস্য উদঘাটনে অন্য রকম কৌশল অবলম্বন করেন।
চমৎকার একটা ফিনিশিং দিয়ে উপন্যাস শেষ হয়েছে। শেষের দিকে বলা হয়েছে-
পৃথিবীটা আসলে রহস্যের জন্য সুন্দর। যদি রহস্য না থাকতো, তাহলে পৃথিবী একসময় মানুষের কাছে একঘেয়ে মনে হতো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া-
এটা একটা রহস্য গোয়েন্দা উপন্যাস। পুরো বইয়ে আমি হারকিউলিসকে খুঁজেছি। লেখক এখানে রহস্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
উপন্যাসের কাহিনিতে বেশ প্রাণবন্ত ছিল। রহস্য উপন্যাস হলেও লেখক এখানে কাহিনীর পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন যা বেশ শিক্ষামূলক। লেখক এখানে প্রশংসার দাবিদার।
উপন্যাসের ভাষা ও শব্দের ব্যবহার বেশ সহজ সরল ও সাবলীল। কঠিন শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কঠিন শব্দের ব্যবহার ছাড়া যে রহস্য গোয়েন্দা উপন্যাস লেখা সম্ভব লেখক এখানে তা প্রমাণ করেছেন। ফ্যান্টাসি এই জগতে প্রবেশ করতে আমি বলব পাঠকদের বইটা পড়তে।
আশা করি, সময়টা ভালো কাটবে।
এবার আসি, বইয়ের খারাপ লাগা দিক নিয়ে৷ প্রথম অধ্যায়ে লেখক দু'জায়গায় ভোদাই শব্দটা ব্যবহার করেছেন। যা আমার কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছে। লেখক এখানে চাইলে অন্য শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন।
শেষের দিকে, গল্পের কাহিনি যেনো লেখক তাড়াহুড়ো করে শেষ করেছেন। লেখক এখানে চাইলে আর একটু ধীরস্থির হতে পারতেন। এছাড়া আর তেমন অসঙ্গতি চোখে পড়েনি।
বইয়ের নাম: হারকিউলিস রহস্য
লেখক: মুহাম্মাদ ইব্রাহীম
ধরণ: গোয়েন্দা উপন্যাস
প্রচ্ছদ: মো. আবিদ মিয়া
প্রকাশনী: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রকাশকাল:ফেব্রুয়ারি ২০২১
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২ টি
মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
রিভিউ করেছেন জায়েদ আল মাহমুদ
Post a Comment