সুলেইমান শাহ বনাম চেঙ্গিস খান: কালের বিচারে কে জয়ী?

ওমর খালেদ রুমি  

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অর্থাৎ ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খান যখন “বুরখান খালদুন” পর্বতের পাদদেশে সকল মোঙ্গল গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে পুরো পৃথিবীকে তার প্রতিহিংসার আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করার কথা ভাবছিলেন ঠিক তখনই আর একজন মোঙ্গল তাড়িত তুর্কী বীর সুলেইমান শাহ আনাতোলিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে তার ছোট্ট কাই গোত্রটিকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন।


দুজনের জীবনেই সংগ্রাম ছিল। কিন্তু পার্থক্য ছিলো দর্শনে। চেঙ্গিস খান জীবনে এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন যা তাকে মানবরূপী পশুতে পরিণত করেছিলো। তার ধর্ম টেংরিজম তাকে এর চেয়ে ভালো কিছু শেখাতে পারেনি। অপরদিকে আল্লাহ্র সৈনিক সুলেইমান শাহ মাত্র দুহাজার জনগোষ্ঠীর এমন একটি গোত্রের অধিপতি যাদের নিজেদের কোন আবাসভূমি না থাকা সত্ত্বেও ইসলামের বলে বলীয়ান হয়ে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। তার সন্তানদেরও তিনি সেইভাবে গড়ে তুলেছিলেন। গুণদুগদু বে, সুংগুরতেকিন বে, আরতুগ্রুল গাজী এবং দুনদার শাহকে তিনি চেষ্টা করেছেন অন্যায়ের বিরূদ্ধে মরণপণ লড়াই করতে শিখতে। অপরদিকে চেঙ্গিস খান তার সন্তান জোচি, ওগেদেই, চাগাতাই, তলুইকে শিখিয়েছিলেন নৃশংসতা।


১২২৫ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন সুলেইমান শাহ। ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানও বিদায় নিলেন। চেঙ্গিস খান যখন বিদায় নেন তখন তিনি ১ কোটি বর্গকিলোমিটারেরও বেশি আয়তনের এক বিরাট সা¤্রাজ্যের অধিপতি যা তার ছেলেদের মধ্যে বিভাজিত। জোচির অধীনে ছিলো গোল্ডেন হোর্ডে, চাগাতাই এর অধীনে চাগাতাই খানাটে, তলুই এর অধীনে ইলখানাটে আর ওগেদেই এর অধীনে তার সা¤্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু “গ্রেট মোঙ্গল এম্পায়ার”। 


আর এদিকে সুলেইমান শাহের মৃত্যুর পর তার ছেলে অরতুগ্রুল গাজী তখনও তার গোত্রের জন্য একটি জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেলজুক সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদকে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করে তার মন জয় করে বাইজান্টাইন সীমান্তের কাছাকাছি সোগুত নামক একটি জেলায় বসবাসের অনুমতি লাভ করেন। 


মোঙ্গলদের উৎপাত আগেও ছিলো। ১২৪৩ সালে কোসেদাগের যুদ্ধে সেলজুকরা পরাজিত হলে সেলুজক সাম্রাজ্য মোঙ্গলদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য এর অনেক আগেই অর্থাৎ ১২১৯-১২২১ সালের মধ্যে মধ্য এশিয়া অভিযানের শুরুতেই মোঙ্গলরা তৎকালীন দুনিয়ার অন্যতম রাজশক্তি মুসলিম খাওয়ারিজমান সা¤্রাজ্যকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিলো। ১২৩১ সালে শেষ খাওয়ারিজমান শাহ জালাল আদ দ্বীন মিংবার্ণুর মৃত্যু হলে খায়োরিজমানদের শেষ প্রতিরোধটুকুও শেষ হয়ে যায়।


যে প্রসঙ্গে ছিলাম। মোঙ্গলরা ক্রমশঃই সামনের দিকে আগাতে থাকে। এ পথে তারা তেমন কোন শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি না হলেও তুর্কী কাই গোত্রের প্রধান আর্তুগ্রুল গাজীর কাছ থেকে শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। অবশ্য আর্তুগ্রুল গাজী এই সময়ের মধ্যে কারাকাইজার দুর্গ এবং নাইট টেম্পলারদের দূর্গ দখল করে নিয়ে কিছুটা হলেও নিজের পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেয়েছিলেন। যদিও বিশাল মোঙ্গল বাহিনীর সামনে এটাকে কোন অবস্থানই বলা যায় না। 


এ সময়ের মধ্যে কিছু নাটকীয় ঘটনাও ঘটে। চেঙ্গিস খানের পুত্র জোচির পুত্র বার্কে খান ১২৫১ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বার্কে খানের এক ভাইপো নোগাইও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১২৫৮ সালে ইলখানাটের দায়িত্বে থাকা চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান যিনি চেঙ্গিস খানের পুত্র তলুইয়ের পুত্র বাগদাদ আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিলে মুসলিম বার্কে খান ভীষণ মর্মাহত হয়। তিনি নোগাইকে নিয়ে হালাকুকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হন। এ পথে তিনি তুর্কীদের সহযোগিতা বিশেষ করে আর্তুগ্রুল গাজীর সহযোগিতা লাভ করেন। 


মোঙ্গলরাও বসে ছিল না। তারা বাইজান্টাইনদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করে আফ্রিকার মামলুক সা¤্রাজ্যের দিকে আগানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বিধি বাম। ১২৬০ সালে আইন জালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলরা পরাজিত হলে আফ্রিকার উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা থেমে যায়। তাদের ইচ্ছে ছিলো উত্তর আফ্রিকা হয়ে তারা ইউরোপের দিকে অগ্রসর হবে। এদিকে বারকে খান নোগাইকে নিয়ে হালাকু খানকে প্রতিহত করতে আসার কারণে সে যাত্রা তার পক্ষেও ইউরোপে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। 


১২৬১-১২৬৬ সালের মধ্যে বাটু খান, হালাকু খান, আরিক বোকে, বার্কে খান সবার মৃত্যু হলে মোঙ্গলদের বিধ্বংসী অগ্রযাত্রা সে যাত্রা থেমে যায়। “গ্রেট মোঙ্গল এম্পায়ারের” কর্তৃত্বে তখণ কুবলাই খান। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১২৬০ থেকে ১২৯৪ সাল পর্যন্ত। ১২৯৪ সালে মৃত্যুর সময় তার সা¤্রাজ্যের আয়তন ছিলো ২ কোটি ৪০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার যা অর্জিত হয়েছিলো চেঙ্গিস খান, ওগেদেই খান, গিউক খান, মঙ্গকে খান এবং কুবলাই খান কর্তৃক আর এতে সময় লেগেছিলো প্রায় ১০০ বছর। 


এদিকে ১২৮১ সালে আর্তুগ্রুল গাজী যখন মারা যান তখন তার ২২ বছর বয়সী ছেলে ওসমান গাজী পিতার তরবারী হাতে তুলে নেন। অনেক লড়াই সংগ্রাম শেষে তিনি ১২৯৮ সালে একটা মোটামুটি শক্ত অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হন। তিনি বেঁচে ছিলেন ১৩২৬ সাল পর্যন্ত। অবশ্য মারা যাওয়ার সময়ও যে তিনি খুব বেশী বড় কোন সা¤্রাজ্য রেখে যেতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। তিনি কুলু কাইজার দুর্গ দখল করে তার অবস্থানকে কিছুটা হলেও শক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 


তার মৃত্যুর পর তার ছেলে ওরহান দায়িত্ব নেন। ওরহানের সময়কালে তিনি বেশ কিছু সাফল্য লাভ করেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর বুসরা দখল করে তাকে রাজধানী ঘোষনা করেন। ওরহানকে এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আর এভাবেই রচিত হয়েছিলো উসমানীয় খেলাফতের ভিত্তিমূল যাদের ৩৭ জন সুলতান পরবর্তী ৬২৫ বছর তাদের সা¤্রাজ্যকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সা¤্রাজ্য হিসেবে টিকিয়ে রেখেছিলো। ওদিকে ১৩৩৫ সালে “গ্রেট মোঙ্গল এম্পায়ার” এর শেষ শাসক তোঘোন তিমুর এর মৃত্যু হলে মোঙ্গল সা¤্রাজ্য কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

0/Post a Comment/Comments