বাংলাদেশ-ভারত সাম্প্রতিক চুক্তি ও আমাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


দুপুরে ইন্ডিয়াহ্যাবিট্যাট সেন্টারে লাঞ্চের ফাঁকে তুমুল আড্ডা। সঙ্গে দৈনিক কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলন ভাই, দৈনিক সংবাদের আলতামাস কবির ভাই আর অনুজ প্রতিম রাশেক রহমান। আমাদের হোস্ট ইন্ডিয়ান টাইমসের এক জন সিনিয়র সাংবাদিক। দিল্লিতে আমাদের এবারের যাওয়াটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে। কিছুক্ষণ আগেই দুই সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে স্বাক্ষর হয়েছে একগুচ্ছ চুক্তি। রাতে ডিনারে আমাদের জমানার তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা আর আজকের মাননীয় পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ভাই বলছিলেন— বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার জন্য খাবারের পানি সরবরাহ করবে। বাংলাদেশ সরকারের হয়ে তিনি সকালে ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন। ইন্ডিয়াহ্যাবিট্যাট সেন্টারের লাঞ্চের আড্ডায় বসেই টের পাচ্ছিলাম এই চুক্তিগুলোতে বিতর্কিত করার জন্য এরই মধ্যে দেশে নেমে পড়েছে একদল লোক। আর সন্ধ্যায় হোটেলের রুমে ঢুকে ফেসবুকে লগইন করতেই বুঝলাম ভারতীয় দালালি আর ভারতের কাছে দেশ বিক্রির পুরাতন বস্তাপচা তত্ত্ব আবারও ফেনী নদী, এলপিজিআর রাডারের নতুন মোড়কে ভরে বাঙালিকে আরো একবার গেলানোর চেষ্টা চলছে পূর্ণদ্যোমে।


এবারের বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে চুক্তিগুলো নিয়ে অপপ্রচার বেশি হয়েছে তার দুইটি ত্রিপুরা কেন্দ্রিক। ভারতের এই ক্ষুদ্র প্রদেশটির কাছে আমাদের ঋণ কোনো দিনও শোধ হবার নয়। একাত্তরে ত্রিপুরার চৌদ্দ লাখ অধিবাসী আপন করে নিয়েছিলেন পনেরো লাখ বাংলাদেশি শরণার্থীকে। এমনটি ত্রিপুরার রাজপরিবার আগরতলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তাদের রাজপ্রাসাদটিও উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এপার থেকে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য। ত্রিপুরার আগরতলা, মেলাঘর, সাব্রুম—এসব জায়গার নাম বাদ দিয়ে একাত্তরের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। যে সাব্রুমে খাবারের পানি সরবরাহ করা নিয়ে এত কথা, সেখানকার অধিবাসীরা ১৫০ একরেরও বেশি ব্যক্তিগত জমি দান করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি উদ্যান নির্মাণে। যতদূর জানি সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর পৃথিবীর বৃহত্তম টেরাকোটাম্যুরাল। স্থাপিত হয়েছে জাতির পিতার বিশাল আবক্ষমূর্তি। এই মুহূর্তে সাব্রুমে খাবার পানি সরবরাহের জন্য ডিপ টিউবয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে ভূগর্ভে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেমন ভারত, তেমনি আমরাও। কারণ ভূগর্ভের পানি আন্তর্জাতিক সীমানা মানে না। আর যে পরিমাণ পানি ফেনী নদী থেকে সাব্রুমে সরবরাহ করা হবে তা নদীটির গ্রীষ্মকালীন সর্বনিম্ন প্রবাহের মাত্র ০.২৩ শতাংশ। নিশ্চিত জেনে রাখুন, এই আমি-আপনি এই ঢাকা শহরে প্রতিদিন দাঁতব্রাশ কিংবা কাপড় ধোয়ায় এরচেয়ে ঢের বেশি পানি অপচয় করি।
আর যারা যুক্তি দেখান যে, তিস্তার পানি না পেয়ে ফেনীর পানি দিয়ে দেওয়াটা একটি কূটনৈতিক অপরিপক্বতা, তারা কি একবারও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক প্রজ্ঞাটা বোঝার চেষ্টা করেন? দেশে কিছু অবুঝ আর বুঝেও না বোঝা শ্রেণির আপত্তি সত্ত্বেও ফেনী নদীর পানি দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু তার মানবিক দিকটাকেই যে আরেকটু উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাই নয় বরং এতদিন যে মমতা ব্যানার্জী ঘরে বিরোধিতার যুক্তি দেখিয়ে তিস্তার পানিবণ্টনে গাঁইগুঁই করে আসছিলেন তিনিও এখন ব্যাকফুটে। পাশাপাশি একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের ত্রিপুরার কাছে যে ঋণ, তার কিছুটা হলেও শোধ হয়েছে এরমধ্যে দিয়ে।
ভারতে গ্যাস বিক্রির গপ্পোটা আরো চিত্তাকর্ষক। গল্পের শুরু বিদেশি এক প্রচার মাধ্যমের একটি খবরের সূত্রধরে। তারাই প্রথম প্রচার করেছিল যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতে গ্যাস বিক্রির চুক্তি করে এসেছেন। ঘণ্টাখানেক পরে তারা অবশ্য তাদের খবরটি প্রত্যাহার করে নেয়; কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রাণও হারিয়েছেন এক শিক্ষার্থী। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ বিদেশ থেকে এলপিজি আমদানি করছে ট্যাংকারে ভরে। দেশে একাধিক বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সেগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ করে মেটানো হচ্ছে দেশের চাহিদা। আপনি, আমি—আমরা অনেকেই আমাদের রান্না-বান্নার কাজে ব্যবহার করছি এই এলপিজি। দেশের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি এলপিজি ত্রিপুরায় রপ্তানি করায় দোষের যে কী তা হাজার চিন্তায়ও আমার মাথায় ঢোকেনি। আমি তো বরং প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের রপ্তানি বাস্কেটে একটি নতুন পণ্য সংযোজনের জন্য। আর যারা অর্বাচীনের মতো এর বিরোধিতায় মেতেছেন, আমার তো ভয় হয় কোনো দিন তারা হয়তো আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টস রপ্তানির বিরুদ্ধেও কথা বলবেন। কারণ আমরা তো থানকাপড় আমদানি করে, এদেশে স্টিচিং শেষে বিদেশে রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছি।
সবশেষে রাডার তত্ত্ব। বলা হচ্ছে, ভারতীয় সহায়তায় যে রাডারগুলো কেনা হবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতীয়দের হাতে। এটি সর্বৈব মিথ্যা। রাডার নিয়ন্ত্রণ করবে আমাদের কোস্ট গার্ড সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের নতুন বিশাল জল সীমায় নজরদারির কাজে। যারা এসব বানোয়াট তথ্য বাজারে ছাড়েন তাদের উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার; কিন্তু যারা এসব বিশ্বাস করেন তাদের কি ধারণা আমাদের সাবমেরিন দুটো চালায় চীনারা, আর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ আছে নাসার নিয়ন্ত্রণে? যদি সে রকমই বিশ্বাস করেন তাহলে কারা এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন না কেন সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
আসলে ভারত-বাংলাদেশের সর্বশেষ চুক্তিগুলো বাংলাদেশের আরেকটি অনন্য কূটনৈতিক বিজয় ছাড়া আর কিছু নয়। আর এমন বিজয় আমরা দেখেছি দফায় দফায় এই সরকারের জমানায়। দেখেছি যখন আমরা বিনাযুদ্ধে করেছি সমুদ্র জয় কিংবা ভারত-বাংলাদেশ স্থল বিনিময় চুক্তিতে, যেখানে ভারতের ভৌগোলিক আয়তন কমেছে আর বেড়েছে আমাদেরটা। একটু যদি মন দিয়ে ভাবেন দেখবেন সিরিয়া থেকে আরাকান কিংবা লিবিয়া থেকে ভেনেজুয়েলা, পৃথিবীতে দেশে দেশে যত হানাহানি তার মূলে ‘জ্বালানি’, আর আগামীর পৃথিবীতে সব সংঘাতের উত্স হবে ‘পানি’। আগামীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর সিমবায়োটিক গ্রোথ নিশ্চিত করার মূলই হচ্ছে জ্বালানি আর পানির ক্ষেত্রে সংঘাত নয় বরং সহযোগিতা। আর কেউ বিষয়টা বুঝুক চাই না-বুঝুক, এটি যথার্থই অনুধাবন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments