বছরে বেকারের পরীক্ষা ব্যয় ৩০-৪০ হাজার টাকা


চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে দিনাজপুর থেকে ঢাকা এসে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের  ফটকে গিয়ে সাইয়ান কাদির দেখেন, ‘অনিবার্য কারণবশত অনির্দিষ্টকালের জন্য  পরীক্ষা স্থগিত’। এরপর দিনাজপুর সরকারি কলেজের এই শিক্ষার্থী রাজধানীতে  বন্ধুর মেসে দুদিন থেকে ফিরে যান। এই সময়ে শেষ হয়েছে ধার করে আনা তার আড়াই  হাজার টাকা। একই কলেজের মোস্তারুল ইসলাম চাকরির পরীক্ষা দিতে প্রায় প্রতি  শুক্রবার ঢাকা আসেন। প্রতিবার তার হাজার তিনেক টাকা খরচ হয়। তার ভাষ্য,  স্নাতক শেষে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির  পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। আবেদন করা থেকে পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত ৬০ হাজার  টাকার বেশি তার ব্যয় হয়েছে, যা তার দরিদ্র কৃষক বাবাকে বহন করতে হয়েছে।সাইয়ান কাদির ও মোস্তারুল ইসলামের মতো লাখো তরুণ শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি  চাকরির পেছনে ছুটছেন। প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি চাকরির পেছনে  ছুটে বছরে শত কোটি টাকা ব্যয় করছেন বেকাররা। তবে চাকরি পাওয়া ব্যক্তির  সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।এই অবস্থায় বেকারদের আর্থিক চাপ কমাতে বিনামূল্যে আবেদন, সংশ্লিষ্ট  এলাকায় পরীক্ষার কেন্দ্র করা, প্রয়োজনে অনলাইনভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতির  পরামর্শ দিয়েছেন শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।কয়েক বছর ধরে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছেন এ রকম অন্তত ১০ তরুণের  সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, বছরে তারা গড়ে ১৫টি  করে পরীক্ষা দিয়েছেন, এর অন্তত ১০টিই হয় ঢাকায় হয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষার  জন্য আবেদন, প্রিন্ট, অনলাইন বিল, কুরিয়ার বিল, ব্যাংক ড্রাফট, পোশাক,  কোচিং খরচ, পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসা-যাওয়াসহ ৩-৪ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আবার  লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সাক্ষাৎকারের জন্য আসতে হয়। এই হিসাবে বছরে  একজন শিক্ষিত বেকারকে ৩০-৪০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এদের মধ্যে যাদের  চাকরি হয়, তারা হিসাব পুষিয়ে নিতে পারেন। তবে যারা চাকরি পান না, তারা  বছরের পর বছর আশার বৃত্তে ঘুরপাক খান। এভাবে বছর সাতেক একজন তরুণ সরকারি  চাকরির পেছনে লেগে থাকতে পারেন। এই সময়ে সরকারি চাকরি প্রত্যাশীকে ৩-৪ লাখ  টাকা ব্যয় করতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেও যা  ব্যয় হয় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের খানা জরিপ  অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এদের মধ্যে ৪০ শতাংশকে  উচ্চশিক্ষিত (স্নাতক পাস) বেকার বলেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এ  হিসাবে দেশে বর্তমানে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষিত বেকার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়  মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হিসাবে, প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ তরুণ শিক্ষাজীবন  শেষে চাকরির প্রার্থীর তালিকায় যোগ হচ্ছেন। এদের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার তরুণ  সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। বাকিদের মধ্যে অনেকে বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা,  উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন, তবে বড় অংশই বেকার থাকছেন। আবার যারা  বেসরকারি চাকরিতে ঢুকছেন তারাও সরকারি চাকরির চেষ্টা করছেন। এই বিপুল  সংখ্যক সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ কয়েক ধাপে অর্থ ব্যয় করছেন, যা পরিবারের  ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে।সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) সূত্রে জানা গেছে, ৪০তম বিসিএসে আবেদন করেন ৪  লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী। পিএসসিতে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর আবেদনের  রেকর্ড এটি। কেবল আবেদন করতে প্রতি প্রার্থীকে ৭০০ টাকা পিএসসিকে দিতে  হয়েছে। এ হিসাবে পিএসসি ৪০তম বিসিএসের আবেদন থেকে ২৮ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার  ৪০০ টাকা পেয়েছে।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি  চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ড্রাফট করতে  হয়। চলতি বছর ১৬তম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় (এনটিআরসি) আবেদন করেন  ১০ লাখ ৩৫ হাজার চাকরিপ্রত্যাশী। এর প্রতিটি আবেদন ফরমের মূল্য ছিল ৩৫০  টাকা। এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির কোষাগারে প্রথম ধাপেই জমা পড়ে ৩৬ কোটি ২২ লাখ  ৫০ হাজার টাকা। পরীক্ষার কয়েক দফায় উত্তীর্ণ হলেও বছরের পর বছর ঝুলেও  অনেকে নিয়োগ পান না। এভাবে প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানই পরীক্ষার নামে  বেকারের পকেট কাটছে বলে অভিযোগ আছে।স্নাতক পাসের আগ থেকেই সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ  নেন। চাকরি পেতে তরুণদের বড় অংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোচিংও করেন। এতেও  বিপুল অর্থ খরচ হয়। ৫০০ টাকার একটি আবেদন পূরণ করতে অনলাইন বিল, প্রিন্ট,  কুরিয়ার, যাতায়াত বাবদ অন্তত ১ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়,  বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন, বিসিএসসহ বেশ কয়েকটি অধিদপ্তরের পরীক্ষা নিজ জেলা  ও বিভাগীয় পর্যায়ে হয়। তবে মন্ত্রণালয়, ব্যাংক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ  অধিদপ্তরের পরীক্ষা হয় ঢাকায়। এ জন্য বড় ধরনের ঝক্কি পোহাতে হয় চাকরি  প্রার্থীদের। পঞ্চগড় অথবা কক্সবাজার থেকে পরীক্ষার্থীদেরও ঢাকা আসতে হয়।  এদের বেশির ভাগেরই ঢাকায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে  অনেককেই ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিয়েই ফিরে যেতে হয়। আবার অনেকে শুধু চাকরির  পরীক্ষা দিতেই ঢাকায় বাসা ভাড়া করছেন। এভাবে বিপুল অর্থ খরচ করছেন বেকাররা।
বেসরকারি খাত : চাকরির বিজ্ঞাপন দাতা ওয়েবসাইট বিডি জবসের কর্মকর্তাদের  কাছ থেকে জানা গেছে, তাদের মাধ্যমে গড়ে ১৫ হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বছরে  ৪০ লাখ চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেয়। আবেদন পড়ে ২০ লাখের কাছাকাছি। এসব চাকরিতে  আবেদন খরচ প্রয়োজন হয় না। তবে আবেদন-পরবর্তী সময়ে চাকরি প্রার্থীদের  সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। বিভিন্ন সনদ জমা দিতে হয়। সম্প্রতি  চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা এক চাকরি প্রার্থী জানান, অনেকদিন ধরে একটি  চাকরির জন্য ঢাকায় আসা-যাওয়া করছেন তিনি। চাকরি হচ্ছে না, শুধু টাকা নষ্ট  হচ্ছে।বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম দেশ  রূপান্তরকে বলেন, ‘এদেশের বেশির ভাগ মানুষ গরিব। তারা সন্তানদের অনেক কষ্টে  পড়ালেখা করান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের কাজ দেওয়া। কিন্তু আমাদের  রাষ্ট্রযন্ত্র সেটি না করে উল্টো পরিবারের ওপর বেকারত্বের চাপ সৃষ্টি করছে।  আবেদন থেকে নানা ধাপে নিয়োগের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়,  মেধা তালিকায় স্থান নেওয়ার পরও মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে কর্মজীবনে যেতে  হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। চাকরি পদ্ধতির সংস্কার দরকার। প্রয়োজনে সব ধরনের  চাকরির আবেদন ও পরীক্ষা অনলাইনভিত্তিক করে ব্যয় কমাতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন,  ‘বেকারদের স্বার্থেই বর্তমান নিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। ন্যূনতম  যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির অফার দিতে হবে। এতে আবেদনের হার কমবে, খরচও  সাশ্রয় হবে। চাকরি প্রার্থীকে ঢাকায় আনার প্রবণতা কমাতে হবে। অনলাইনে  আবেদনের পদ্ধতিতে টাকা নেওয়ার কোনো পদ্ধতিই রাখা যাবে না।’ পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড.  শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে হারে প্রতি বছর চাকরিপ্রার্থী বাড়ছে,  ব্যবস্থাপনা করাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক দিকটা।  বেকারদের খরচ কমাতে ঢাকার বাইরে কেন্দ্র করার কথা ভাবা হলেও, প্রশ্নপত্র  ফাঁসের ঝুঁকি রয়েছে। তবে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় আরও কীভাবে চাকরিপ্রাপ্তি  সহজ করা যায়, তা নিয়ে সরকার কাজ করছে।’

0/Post a Comment/Comments