শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথম ধাপ। আর এই ধাপ অতিক্রমের জন্য আবশ্যক ফলপ্রসু পাঠদান। ফলপ্রসু পাঠদানের জন্য তিনটি পর্যায়ের উন্নয়ন ও যথাযথ প্রয়োগ আবশ্যক। পর্যায় তিনটি হচ্ছে- ১. পরিকল্পনাও প্রস্তুতি ( planning and preparation) ২. শ্রেনিকক্ষ ব্যবস্থপনা (classroom management) ৩. মূল্যায়ন (assessment) । একটি পরিকল্পনাই পারে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর বাস্তব রুপ দিতে। একমাত্র পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। পাঠ পরিকল্পনা সাধারণত কয়েক ধরনের হতে পারে- বার্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক । প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা (Annual Lesson plan) ও দৈনিক পাঠ পরিকল্পনার ( Daily Lesson plan ) গুরত্ব অনেকটাই বেশি। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহে প্রত্যেক শিক্ষকের শ্রেনি ও বিষয়ভিত্তিক বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা (Annual Lesson plan) তৈরি করা অবশ্য করনীয় কাজ হওয়া উচিত। বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে একজন শিক্ষক একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নির্ধারিত সময়ে পাঠ শুরু ও শেষ করতে পারে। দৈনিক পাঠদান কার্যক্রমের শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। সর্বোপরি যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ অর্জিত হবে বলে প্রতীয়মান হয়। বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করা কি সময়সাপেক্ষ কিংবা ব্যয়বহুল অথবা ঝামেলাপূর্ণ? মোটেই না। বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন কয়েক সীট সাদা কাগজ, ক্যালেন্ডার , ছুটির তালিকা ও পাঠ্যপুস্তক। ক্যালেন্ডার দেখে প্রথমে সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিতেহবে এবং ছুটির তালিকা হতে নির্ধারিত ছুটিগুলো বাদ দিতে হবে। এছাড়া পরীক্ষার সময় বাদ দিয়ে কার্য দিবস বের করে নিতে হবে। মাস ভিত্তিক মোট কার্যদিবস বের করার পর বিষয়বস্তুর পরিসর অনুসারে পিরিয়ড সংখ্যা নির্ধারন করে নিলেই বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনার কাঠামো প্রস্তুত হবে। উক্ত কাঠামোকে ভিত্তি করে এক একজন শিক্ষক তার সৃজনশীল চিন্তা চেতনার দ্বারা বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনার শৈল্পিক রুপ দিতে পারে। শুধু যে একজন শিক্ষকের বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা থাকবে তা না এমনকি শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অফিসার অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকি করেন যারা তাদের সকলের বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনায় সপ্তাহে ন্যূনতম একটি পিরিয়ড পাঠদানের বন্দোবস্ত থাকলে মনে হয় শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে অনেকটাই ভূমিকা রাখবে। একজন অফিসার যখন সরাসরি পাঠদান কাজে সম্পৃক্ত হবেন তখন তিনি শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি, শ্রেণি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন,মূল্যায়ন কৌশলের উন্নয়ন এমনকি ক্যারিকুলামের উন্নয়নের বিষয়ে প্রত্যক্ষ মতামত প্রদান করতে পারবেন। সেই সাথে সারাদেশে প্রতি সপ্তাহে একযোগে অনেক অনেক শিক্ষার্থী চৌকস অফিসারের মাধ্যমে motivated হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী(২০১৮) , বাংলাদেশের একজন শিশু বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা পেলে তারা শতভাগ কর্মদক্ষতা দেখাতে পারত, সেখানে তারা অর্ধেকের কম দেখাতে পারবে।বাংলাদেশের একটি শিশু ৪ বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করে ১৮ বছর পার হওয়ার আগে গড়ে ১১ বছর শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় থাকে। অন্যদিকে ভারতের শিশু ১০ দশমিক ২ বছর ও পাকিস্তানের শিশু ৮ দশমিক ৮ বছর স্কুলশিক্ষা পায়।বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে বেশ ভালো করছে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, খর্বাকৃতি ও মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবই বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়তে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে।সুতরাং মান সম্পন্ন শিক্ষা অর্জন বাংলাদেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবলায় পরিকল্পনাও প্রস্তুতি ( planning and preparation) একটি বড় ধরনের হাতিয়ার। পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি পর্যায়ের সবচেয়ে বেশি কার্যকর টুলস হচ্ছে দৈনিক পাঠ পরিকল্পনা।দৈনিক পাঠ পরিকল্পনা কি? এক কথায় বলা যায়, পাঠ পরিকল্পনা হচ্ছে – শ্রেণিকক্ষে ফলপ্রসূ পাঠদানের জন্য আনন্দদায়ক ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্বলিত একটি লিখিত দলিল। পাঠ পরিকল্পনা একটি সৃজশীল কর্ম। পাঠ পরিকল্পনা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির,একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একজন শিক্ষকের শিক্ষাদানের চিন্তন প্রক্রিয়ার একটি লিখিত পরিকল্পনা।পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে কথা তুললে প্রথমেই চলে আসে হার্বাটের পঞ্চসোপানের কথা। IPT অর্থাৎ input, practice task English lesson Plan এ আমাদের দেশে ব্যাপক আলোচিত acronym. যা PPP এর অনুকরণ presentation , practice and product. Language teaching এর ক্ষেত্রে WIPPEA বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। WIPPEA এর পূর্ণরুপ warm up, introduction, presentation, practice , evaluation and aplication. Math Teaching এর ক্ষেত্রে concreate,semi concreate and abstruct এই তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। যেহেতু মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের তিনটি পর্যায়ের ১ম পর্যায় হচ্ছে ১. পরিকল্পনাও প্রস্তুতি ( planning and preparation) সেহেতু দৈনিক পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করা প্রত্যেক শিক্ষকের অবশ্য করনীয় কাজ হওয়া উচিত। পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করা আদৌ কোনো জটিল কাজ নয়। পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য হাতের কাছে আপনার প্রয়োজন পাঠ্য পুস্তুক ও শিখনক্রম/কারিকুলাম ।A4 সাইজের কাগজের প্রথমে শ্রেণি , বিষয়, পাঠ ও পাঠ্যাংশ উল্লেখ করতে হবে। পরে বিষয়বস্তুর নিরিখে শিখনফল লিখতেহবে। পরের ধাপে থাকবে নিরাপত্তাবোধ পরিবেশ সৃষ্ট ও আবেগ সৃষ্টি। এর পর থাকবে শিক্ষকের কার্যাবলি। শিক্ষক ইচ্ছা করলে এটিকে কয়েকটি কলাম ও সারিতে বিভক্ত করে নিতে পারে। ধাপ/পর্যায়, শিক্ষক যা করবে/বলবে, শিক্ষার্থী যা করবে/ বলবে,সময় বিভাজন , TLMs ,পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
মোঃ তাজুল ইসলাম
প্রধান শিক্ষক
আমজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
শিবগঞ্জ, বগুড়া।
Post a Comment