একটি ঝড়ের রাত
প্রতিবছরই বৈশাখ মাসের শুরুতে কালবৈশাখী ঝড় হয়। সেই ঝড়ের ভয়াবহতা গেল বছর নানা বাড়িতে গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়ে আমি প্রথম প্রত্যক্ষ করি, সেই বৈশাখীর
দিনের সকালের আকাশটা ছিল সুন্দর। দুপুরের আকাশেও কালো মেঘের কোনো চিহ্ন ছিল না। সারা দিনের প্রচণ্ড গরমে নিজেই প্রত্যাশা করছিলাম বায়ুবেগে একখণ্ড মেঘ একটু বাতাসের ঝাপটা আর সেই সাথে কিছু বৃষ্টি। আমার এ প্রত্যাশা ব্যর্থ হলো না।
দিনের সকালের আকাশটা ছিল সুন্দর। দুপুরের আকাশেও কালো মেঘের কোনো চিহ্ন ছিল না। সারা দিনের প্রচণ্ড গরমে নিজেই প্রত্যাশা করছিলাম বায়ুবেগে একখণ্ড মেঘ একটু বাতাসের ঝাপটা আর সেই সাথে কিছু বৃষ্টি। আমার এ প্রত্যাশা ব্যর্থ হলো না।
আমি তখন ঘরে বসে হারিকেন জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। এমন সময় সোঁ সোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝলাম বাতাস উঠেছে। আনন্দে ঘর থেকে দৌড়ে বের হলাম আম কুড়ানোর জন্য। দেখলাম সমস্ত বায়ুমণ্ডল যেন ধুলার সমুদ্র। ওরই মধ্যে কাপড়ের কোঁচা ভর্তি করে আম কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত বৈঠকখানার ঘরে ঢুকলাম। ঝড়ের রূপ তখন ভয়াবহ, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি।
বাতাসের ঝাপটায় এক-একবার মনে হতে লাগল, এই বুঝি পুরো ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পশ্চিম দিকের ঘরের চাল হঠাৎ আলগা হয়ে গেল।
চোখের পলকে পেছনের চালটাও উড়ে গেল। আমরা সবাই ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।
গোয়াল ঘরে গরুর হাম্বা ডাক, মানুষের আর্তচিৎকার, বাতাসের ঝাপটা, সব মিলিয়ে মনে হলো যেন কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে। নানা জোরে শব্দ করে আজান দিতে লাগলেন। মামা চিৎকার করে সবাইকে খাটের নিচে আশ্রয় দিতে বললেন। আমরা তাই করলাম। এভাবে কতক্ষণ ঝড় চলেছে বুঝতে পারিনি। ঝড় থামার পর হারিকেন নিয়ে সবার সঙ্গে বাইরে গিয়ে দেখলাম ঘরের ওপরের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ভেঙে দু্ই টুকরো হয়ে উঠোনে পড়ে আছে।
বরই গাছে ঝুলছে ঘরের টিনটা। একটা ঘুঘু পাখি উঠোনে মরে পড়ে আছে। সে রাতের ঝড়ের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। সে সন্ধ্যায় আমি বুঝেছি, প্রকৃতির প্রচণ্ডতার কাছে মানুষ কত অসহায়, কত নিঃস্ব।
বসন্তকাল
ফাল্গুন-চৈত্র এ দুই মাস নিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। এ ঋতুর আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। পাতাঝরা শীতের বৈরাগ্য ভাব আর থাকে না। পত্র-পুষ্পে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বন-বনানী। বাতাসে নানা ফুলের সৌরভ পাওয়া যায়। শিমুলের লাল থোকা থোকা ফুলের আড়ালে নেচে ওঠে শালিক-ময়না-টিয়ে পাখি। ঘনবনের আড়ালে লুকিয়ে কুহু করে ডেকে ওঠে কোকিল।
বৌ কথা কও পাখির গানে মানুষের মনও প্রকৃতির সঙ্গে আত্মলীন হয়ে যায়। ধান-কাউনের মাঠে মটরশুঁটির লতানো গাছে সরষে ফুলের হলুদ বনে প্রজাপতিরা লুটোপুটি খায়। প্রকৃতির এই মনোরোম শোভা সত্যিই আনন্দের।
আমের শাখায় দেখা যায় নতুন মঞ্জুরি। মৌমাছির গুঞ্জন মৃদুমন্দ দখিনা বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়। তাই বসন্তকে বলা হয় যৌবনের ঋতু। এ সময় না থাকে শীতের তীব্রতা, না থাকে গ্রীষ্মের প্রখরতা, না থাকে বাদল বর্ষণে ধরাপৃষ্ঠের ঝরঝর ক্রন্দন।
প্রকৃতির এমন অনুকূল পরিবেশে জমে ওঠে মেলা, গান, সার্কাস। ঘরে ঘরে বিয়ে-শাদির আয়োজন হয়। তাই ঋতুরাজ বসন্ত সবার কাছেই নন্দিত ও প্রত্যাশিত।
জ্যোৎস্না রাত
চাঁদনি রাতের অপরূপ শোভা দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। ঘটনাচক্রে এক অপরূপ জ্যোৎস্না রাত দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। গেল বছর ছোট খালার বিয়ে উপলক্ষে আমরা সব আত্মীয়স্বজন নানার বাড়ি পলাশতলা গ্রামে একত্র হয়েছিলাম। সে রাতটা যে বৌদ্ধ পূর্ণিমার ছিল আমরা তা জানতাম না।
যখন আকাশের মস্ত রুপালি চাঁদটা উঠল, তখনই মনে পড়ে গেল আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা। শহরে বিদ্যুতের আলোয় চাঁদের জ্যোৎস্না দেখার সুযোগ কখনোই হয়ে ওঠে না। তাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমরা মামাতো-খালাতো ভাইবোন বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। ঝিরিঝিরি বাতাস নির্জন সন্ধ্যা, গ্রামের পথে-ঘাটে কোথাও প্রাণের আভাস নেই। আমরা হাঁটছি, আকাশ থেকে জ্যোৎস্না ঝরছে।
সেই জ্যোৎস্নার ধারা আমাদের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পা বেয়ে বেয়ে যেন মাটিতে পড়ছে, যেন সে রূপের সাগরে হারিয়ে যাবে। বৌদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদও যেন তার সমস্ত মুগ্ধতার আলো ঢেলে দিয়েছে এই গাঁয়ে।
সমস্ত প্রকৃতি যেন জ্যোৎস্নার শুভ্রতায় আত্মলীন হয়ে আছে।
চাঁদের এই শুচি শ্রুভ্র রূপে অভিভূত হয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠলাম রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান- আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তেরই এই বাতাস সমীরণে। এরই মধ্যে মামির কোলের ছোট মামাতো ভাইটা কেন জানি কেঁদে উঠল।
মামির সঙ্গে সঙ্গেই তার কান্না থামানোর জন্য আকাশের চাঁদ দেখিয়ে আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা- ছড়াটি সুরে সুরে গেয়ে উঠলেন। গ্রামের গাছগাছালির ফাঁকে চাঁদের ভেঙে পড়া জ্যোৎস্নায় সেই সুরের আমেজ যেন সবখানে ছড়িয়ে পড়ল।
আমাদের মুগ্ধতা যেন আর শেষ হয় না। মনে মনে বলে উঠলাম- এমন চাঁদের আলো, মরি যেন সেও ভালো। সমস্ত কবিত্ব যেন আমার মধ্যে ভর করতে লাগল। চাঁদের আলোর এত স্নিগ্ধতা এত সৌন্দর্য আছে বলেই কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা আর গান। শুধু কবি-সাহিত্যিক কেন জ্যোৎস্নালোকিত রাতের সৌন্দর্য এক একজনকে করে তোলে কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী।
বর্ষাকাল
ঋতু বৈচিত্র্যের এ বাংলাদেশে গ্রীষ্মের খরতাপ ও রিক্ততায় অবসানের জন্যই শ্যাম সমারোহে বর্ষা আসে আষাঢ়, শ্রাবণ মাস নিয়ে। নিরস ও দঙ্ময় গাছপালা পল্লবিত হয়ে নতুন জীবন লাভ করে। নদী-নালা, খাল-বিলও বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করে। প্রকৃতিতে কদম, জুঁই, চামেলি, শাপলা, পদ্মসহ নাম না জানা ফুল যেমন ফোটে, তেমনি দশদিক আমোদিত হয় আম, কাঁঠাল, জাম, আনারসের সুগন্ধে। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতে এক নতুন প্রাণের হিল্লোল সঞ্চারিত হয়।
বর্ষার আবির্ভাব কেবল প্রকৃতির বুকে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষককুলের সঙ্গে বর্ষার রয়েছে সুমধুর সম্পর্ক। এ সময় কৃষকদের মধ্যে ধান রোপণের হিড়িক পড়ে যায়। এ ছাড়া এ সময়েই তারা আউশ ধান ও সোনালি আঁশ পাট ঘরে তোলে।
পানিবাহিত রোগ-ব্যাধিরও ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে। তার পরও ধান, পাট ইত্যাদি ফসলের সম্ভাবনা কৃষককুলের মনে-প্রাণে বয়ে আনে আনন্দের বার্তা।
বর্ষার পানিতে লোকেরা এ সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে গ্রামীণ জীবনে শ্রী-সমৃদ্ধি সচ্ছলতা এলেও শহরাঞ্চলে পানি জমে ওঠার কারণে নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। উপর্যুপরি বৃষ্টির কারণে মৌসুমি বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। তাই বর্ষা এ দেশবাসীর জীবন-মৃত্যু এবং আশা-নিরাশার প্রতীক, তাদের জীবনেরই প্রতিরূপ।
Post a Comment