তিনি এখনো পিএইচডির ছাত্র। পড়ছেন যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে শিক্ষার ঝুলিতে ডক্টরেট ডিগ্রিটা এখনো জমা না হলেও দিব্যি তিনি ‘ডক্টর’ উপাধি ব্যবহার করছেন। এই উপাধি নিয়ে তিনি একবার পদোন্নতি পেয়েছেন, আরেকবার নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছেন।
পিএইচডি শেষ না করেও এই অসদুপায় অবলম্বন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক অনুপ কুমার সাহা। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আড়াই মাস ধরে সেখানে শিক্ষকতা করছেন।
অনুপ কুমার সাহা অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ জমা দিয়েই পদোন্নতি ও নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিজের নামের সঙ্গে ডক্টরেট ডিগ্রি যুক্ত করে অনুপ কুমার সাহা এ বছরের শুরুর দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। এ বছরের ৮ অক্টোবর তিনি ডক্টরেট হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পুরো এই পদোন্নতি ও নিয়োগপ্রক্রিয়ায় তিনি ডক্টরেট ডিগ্রির সুযোগ নিয়েছেন। অথচ তাঁর পিএইচডি শেষ হয়নি এখনো। অনুপের এই পদোন্নতি ও নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অনুপ কুমার ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান। ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজনেস স্কুলের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থীদের তালিকায় ১৫ নম্বরে রয়েছে তাঁর নাম। ওয়েবসাইটের ‘দি অ্যাওয়ার্ড অব ডিগ্রি’ অংশটিতে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় উন্নীত হওয়ার পর একজন পিএইচডির ছাত্রকে তাঁর অভিসন্দর্ভের একটি ‘ই-কপি’ ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। এরপর তিনি কনগ্রিগেশনে (সনদ প্রদানের অনুষ্ঠান) অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন। সেখানে আরও বলা হয়েছে, পিএইচডির সমস্ত পড়াশোনা এবং গবেষণা জমা দেওয়া হয়ে গেলেও ‘কনগ্রিগেশন’ ছাড়া কোনো ছাত্র পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করতে পারবে না। এই কনগ্রিগেশন অনুষ্ঠিত হয় বছরে দুবার (৮ জুন এবং ১৫ ডিসেম্বর)।
জানতে চাইলে অনুপ কুমার সাহা বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, গত জুন মাসে তিনি ‘কনগ্রিগেশনে’ অংশ নিয়েছেন। সেখানে তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ দেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটে তাঁকে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে দেখানো হচ্ছে, এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি দেখেছি, ওদের আপডেট দেওয়ার বিষয়ে মেইল দেব।’
তবে অনুপ কুমার সাহার এই দাবি সত্য নয়। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের ওয়েবসাইটের নিচে লেখা রয়েছে ওয়েবসাইটটি সর্বশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর তারা হালনাগাদ করেছে। তা ছাড়া ওয়েবসাইটটি ঘেঁটে আরও দেখা যায়, অনুপ কুমার সাহা গত ৬ অক্টোবর ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তাঁর অভিসন্দর্ভের সারসংক্ষেপ আপলোড করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর কনগ্রিগেশনে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়া এখন চলছে।
অথচ অনুপ গত এপ্রিলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছেন ওই মাসেরই ২৩ তারিখ। অনুপের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি দেওয়ার কমিটিতে ছিলেন ছয়জন শিক্ষক। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়োগের কমিটিতে ছিলেন পাঁচজন শিক্ষক। অনুপ পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন কি না, তা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব ছিল এই শিক্ষকদের।
জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চেয়ারম্যান মোহা. আলী নূর প্রথম আলোকে বলেন, অনুপ পিএইচডি ডিগ্রির সনদ জমা দিয়েছিলেন।
তবে অনুসন্ধানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চেয়ারম্যানের দাবি এবং অনুপ কুমার সাহার সনদপ্রাপ্তির দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ কুমার সাহার নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অনুপ তাঁর আবেদনপত্রে নিজেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি সনদ জমা দিয়েছিলেন কি না সে বিষয়টি তাঁর এখন আর মনে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে রক্ষিত তাঁর ফাইল ঘাঁটলে বোঝা যাবে।
প্রশাসনিক ভবনে অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষকদের ফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, অনুপ কুমার সাহা পিএইচডি ডিগ্রির কোনো সনদ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেননি। তিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো যুক্ত একটি ফটোকপি জমা দিয়েছেন যেখানে লেখা রয়েছে ‘এই প্রার্থী পরীক্ষকদের সন্তুষ্ট করেছেন, কনগ্রিগেশনে নিশ্চিত করা হবে।’ এই কাগজের নিচে ৬ অক্টোবর তারিখ উল্লেখ করা রয়েছে। অথচ অনুপ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি পেয়েছিলেন এপ্রিলে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ কমিটি বসেছিল গত ১৩ সেপ্টেম্বর। ২৭ অক্টোবর সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ চূড়ান্ত হয় এবং পরদিন তিনি নিয়োগপত্র পান।
জানতে চাইলে ডেপুটি রেজিস্ট্রার গোলাম সরোয়ার ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি জানার পর তাঁরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখানেও অনুপ পিএইচডি ডিগ্রির কোনো সনদ জমা দেননি বলে জানানো হয়েছে। সনদ না দিলেও কীভাবে অনুপ পিএইচডি ডিগ্রিধারী হিসেবে নিয়োগ পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো যাচাই করার দায়িত্ব নিয়োগ কমিটির। আমাদের নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে একটি সহকারী অধ্যাপক পদে যে সার্কুলার দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ‘অন্যান্য যোগ্যতা সমান থাকলে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার’ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই সার্কুলারের বিপরীতে নয়জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। একমাত্র অনুপ কুমার নিজেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী বলে উল্লেখ করায় তাঁকে সরাসরি ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে অ্যাকাউন্টিং বিভাগের আবদুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিভাগের শৃঙ্খলা কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Prothom Alo
Post a Comment