বাংলা রচনা : পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার

ভূমিকা:সৃষ্টিরআদিলগ্নেমানুষছিলএকান্তভাবেপরিবেশেরউপরনির্ভরশীল মানুষ পরিবেশ তখন একই সূত্রে গাঁথা ছিল কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবেশ মানুষের মধ্যকার মৈত্রী সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকেযেদিনমানুষনিজেদেররুচিঅনুসারেপরিবেশগড়েতুলতেচায়সেদিনথেকেইদেখাদেয়বিশৃঙ্খলা জীবনের তাগিদে, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার
জন্য পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে
পরিবেশপরিবেশদূষণকী: ইংরেজিEnvironment এরবাংলাপ্রতিশব্দপরিবেশ এটি এসেছে ফরাসি শব্দ Environment থেকে যার অর্থ বেষ্টন করা বা ঘেরা সাধারণভাবে বলতে গেলে আমাদের চারপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা, দালানকোঠা, নদ-নদী, খাল-বিল, মাটি, বায়ু, পানি ইত্যাদি সব কিছু মিলেই তৈরি হয় পরিবেশকিন্তুব্যাপকঅর্থেবলতেগেলেমানুষঅন্যান্যপ্রাণী, উদ্ভিদঅনূজীবেরমধ্যকারপারস্পরিকসম্পর্ককেইপরিবেশবলে এস.সি কেন্ডেইগ-এর মতে- ‘পরিবেশ বলতে জৈবিক অজৈবিক বস্তুর যোগফল যা কোনো সৃষ্টির পরিবর্তনে সাহায্য করে তাকে বুঝিকোনো কারণে যদি পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের কাক্সিক্ষত মাত্রা বিনষ্ট হয় বা পরিবেশ জীব জগতের জন্য অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে, তবে সেই অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে পরিবেশ দূষণ বলে
পরিবেশদূষণেরপ্রাকৃতিককারণ:পরিবেশদূষণেরজন্যযেসবপ্রাকৃতিককারণপ্রত্যক্ষএবংপরোক্ষভাবেদায়ীতারমধ্যেবন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নুৎপাত, ভূমিকম্পইত্যাদিঅন্যতম এই বিপর্যয়ের ফলে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, ঘরবাড়ি ইত্যাদির ব্যাপক ধ্বংসলীলা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে এতে পরিবেশে মারাত্মক দূষণের সৃষ্টি হয়ভাটিঅঞ্চলেরদেশগুলোতেবন্যাজলোচ্ছ্বাসেরকারণেব্যাপকসম্পদপ্রাণহানিঘটে বাংলাদেশ, চীন, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ঘূর্ণিঝড়ে, জাপান ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে অগ্নুৎপাতে এবং জাপান, ভারত, ইরানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্পের কারণে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হয়
পরিবেশদূষণেরমানবসৃষ্টকারণ:পরিবেশদূষণেরজন্যমানুষসৃষ্টকারণগুলোইসবচেয়েবেশিদায়ী কারণগুলো হলো-
জনসংখ্যা বিস্ফোরণ: জনসংখ্যা বিস্ফোরণ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণএকটিজরিপেদেখাগেছে১৮০০খ্রীস্টাব্দেযেখানেপৃথিবীরজনসংখ্যাছিল১০০কোটি, সেখানে২০১২সালেতাপ্রায়৭০০কোটিতেদাঁড়িয়েছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এই চাপে পরিবেশ হচ্ছে দূষিত
শিল্পবিপ্লব:অষ্টাদশশতাব্দীতেশিল্পবিপ্লবেরমধ্যদিয়েশিল্পেরযেযাত্রাশুরুহয়েছিলসময়েরসাথেসাথেতারপ্রসারঘটেছে এই শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য ব্যাপকহারে বনজ সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার করে মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে শিল্প কারখানার নির্গত ধোয়া বর্জ্য পদার্থ পরিবেশকে দূষিত করছে
  [ads-post]
বনভূমিধ্বংস:বর্তমানেপরিবেশদূষণেরবড়কারণবনজসম্পদেরধ্বংস একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য যেখানে মোট ভূখন্ডের ২৫% বনভূমি থাকার দরকার তা পৃথিবীর বহু দেশে নেই ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদা মেটাতে, ঘরবাড়ি, আসবাপপত্র শিল্প কারখানা প্রভৃতির জন্য ব্যাপক পরিমাণে বৃক্ষনিধন চলছেএকজরিপেদেখাগেছেবর্তমানেবিশ্বেবার্ষিকবনধ্বংসেরপরিমাণকোটিহেক্টর বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষা মতে- পৃথিবীতে বছরে যে পরিমাণে বন ধ্বংস হচ্ছে তার পরিমাণ প্রতি দশ বছরে ভারতের মোট ভূখন্ডের সমান উপগ্রহের চিত্রের সাহায্যে দেখা গেছে আফ্রিকার ৫৩% এবং এশিয়ায় ৩৫% এলাকায় কোনো না কোনো মাত্রায় মরুময়তা বিরাজ করেপৃথিবীতেবনজসম্পদধ্বংসেরএইপ্রক্রিয়াঅব্যাহতথাকলে২০২০সালনাগাদবিশ্বেরঅনেকঅঞ্চলইমরুভূমিতেপরিণতহবে
যুদ্ধদুর্ঘটনা:যুদ্ধেরসময়ব্যবহৃতপারমাণবিকঅস্ত্র, বোমামরণাস্ত্রেরব্যবহারপরিবেশেরউপরবিরূপপ্রতিক্রিয়াসৃষ্টিকরে ১৯৪৫ সালে জাপানের আনবিক বোমার বিস্ফোরণ, পরবর্তীতে রাশিয়ার চেরোনবিল দূর্ঘটনা, ভারতের ভূপালে গ্যাস দুর্ঘটনা, ২০০৩-০৪ সালে ইরাকে মরণাস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার সকল এলাকার পরিবেশকে ভয়াবহভাবে দূষিত করে তুলেছে
পরিবেশদূষণেরবিভিন্নপ্রক্রিয়া:প্রাকৃতিকমানবসৃষ্টকারণগুলোরজন্যইমাটি, পানি, বায়ুশব্দদূষণেরসৃষ্টিহচ্ছে আর এই দূষণের ফলেই পরিবেশ হয়ে উঠছে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী বাতাসে অতিমাত্রায় মিশ্রিত ক্ষতিকর গ্যাস এবং বিভিন্ন কলকারখানা, মোটরযান জ্বালানির ধোঁয়া থেকে প্রতিনিয়ত বায়ু দূষিত হচ্ছেরাসায়নিকসার, বিভিন্নতেজস্ক্রিয়আবর্জনাজনসংখ্যাবৃদ্ধিইত্যাদিকারণেতেমনিমাটিদূষিতহচ্ছে বিভিন্ন জৈব অজৈব, রাসায়নিক পদার্থ জীবানু দ্বারা দূষিত হচ্ছে পানি এছাড়া বিভিন্ন যন্ত্রের জোরালো শব্দের জন্য ঘটছে শব্দ দূষণ
পরিবেশদূষণজলবায়ুপরিবর্তন:বিশ্বব্যাপীপরিবেশদূষণেরহারবেড়েইচলছে তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর ওপর যার ফলে জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছেমানবসৃষ্টবিভিন্নকারণেবায়ুম-লে কার্বন-ডাই-অক্সাইট, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এর ফলস্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রা ব্যাপকহারে বাড়ছে যা গ্রিন হাউজ ইফেক্ট নামে পরিচিতজার্মানভিত্তিকগবেষণাসংস্থাপস্টজামইনস্টিটিউটফলক্লাইমেটইমপ্যাক্টরিসার্চএরদেয়াতথ্যমতেবিশ্বেকার্বননিঃসরণেরপরিমাণযেহারেবাড়ছেতাযদিঅব্যাহতথাকেতাহলে২০৯০সালেরমধ্যেবৈশ্বিকতাপমাত্রা৪০বৃদ্ধিপাবে বিজ্ঞানীদের মতে এই গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে সমুদ্রের পানি ২০ থেকে ১৪০ সে.মি বৃদ্ধি পাবে এর ফলে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার অনেক দেশই পানিতে ডুবে যাবেমানবজাতিরজন্যএটিমারাত্মকহুমকিস্বরূপ
পরিবেশদূষণেরপ্রতিক্রিয়া:পরিবেশদূষণেরবিরূপপ্রভাবপড়েছেজনজীবনেরউপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনূর্ধ্ব বছরের শিশু মৃত্যুর সংখ্যা কোটি ১০ লাখ যার শতকরা ৭০ ভাগ পানি দূষণের ফলে হয়ে থাকে এছাড়া বায়ু দূষণের ফলে সৃষ্ট শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত কারণে ঘটা মৃত্যুর সংখ্যা ২২ লাখের মতোঅন্যদিকেজাতিসংঘপরিচালিতএকজরিপেদেখাগেছেপরিবেশদূষণেরফলেএশিয়ারআকাশেতিনকিলোমিটারপুরুধোঁয়াশাজমেছে যা এসিড বৃষ্টি ঘটাতে পারে এটি এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবেএছাড়াপ্রাকৃতিকদূষণেপৃথিবীরতাপমাত্রাবৃদ্ধিরফলেহেপাটাইটিসবি, সংক্রামণসেরিব্রাল, পোলিও, কলেরাইত্যাদিরোগবৃদ্ধিপেতেপারে একই সাথে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে চামড়ার ক্যান্সার চোখের ছানি পড়া রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে এমনকি খাদ্যশষ্যে তেজস্ক্রিয়াও বেড়ে যেতে পারে
প্রতিরোধে করণীয়:পরিবেশদূষণপ্রতিরোধেসর্বপ্রথমমানুষেরমধ্যেসচেতনতাবৃদ্ধিকরতেহবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে যন্ত্র গাড়ি থেকে নির্গত ক্ষতিকর গ্যাস রোধ করতে হবেএরবিকল্পস্বরূপপ্রাকৃতিকগ্যাসসৌরশক্তিনির্ভরযন্ত্রেরব্যবহারবৃদ্ধিকরতেহবে নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে এবং বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে রাসায়নিক সার কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে
বিশ্বব্যাপী গৃহীতপদক্ষেপ:পরিবেশদূষণেরমারাত্মকপ্রতিফলনদেখেবিশ্ববাসীআজউদ্বিগ্ন তাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিভিন্ন সম্মেলন ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জাতিসংঘের মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়এরসিদ্ধান্তঅনুযায়ীপ্রতিবছরজুনবিশ্বব্যাপীপরিবেশদিবসপালিতহয় এই সম্মেলনের মাধ্যমেই পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া শুরু হয় এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ ২০১২ সালে ব্রাজিলের রিওতে, ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে, ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সম্মেলন যাতে পরিবেশ সংরক্ষণে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে
বাংলাদেশে গৃহীতপদক্ষেপ: পৃথিবীরঅন্যান্যদেশেরসঙ্গেতালমিলিয়েবাংলাদেশওএগিয়েচলেছেপরিবেশদূষণপ্রতিরোধে এজন্যই ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পাশ করা হয় বাংলাদেশে পরবর্তীতে ২০০২ সালে সংশোধিত পরিবেশ সংরক্ষণ বিল পরিবেশ আদালত বিল পাশ হয়েছেএছাড়াটু-স্টোক যানবাহন নিষিদ্ধ করে এর পরিবর্তে সিএনজি চালিত যানবাহনের ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে এমনকি ২০০২ সাল থেকে সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়
উপসংহার: আজকের দিনে পরিবেশ দূষণ বিশ্বজগতের জন্য একটি বিরাট হুমকিপরিবেশদূষণেরফলেমানুষেরঅস্তিত্বআজচরমসংকটে তাই পরিবেশ দূষণরোধে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি সমষ্টিগতভাবে তা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াতে হবে আগামী দিনের জন্য একটি সুস্থ বসবাস উপযোগী দুষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলাই হোক সকলের অঙ্গীকার

0/Post a Comment/Comments