শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিঃ ধারণা, গুরুত্ব ও উপোযোগীতা

মোঃ আহসানুল আরেফিন চৌধুরী

সহকারি অধ্যাপক
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পাবনা
ভূমিকা
শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য  হলো শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদান করে তাদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করা।
শিক্ষার্থীদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা হয় আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা।

আবার শিক্ষা কার্যক্রমের মূল প্রক্রিয়ায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের সাথে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করার মাধ্যমে তাদেরকে প্রয়োজনীয় তথ্য, জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদান করা শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কথাবার্তা ও কাজের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ করেন যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে শিখনিয় বিষয়সমূহ আয়ত্ব করাতে সহায়তা করা। এই কাজটিকে সহজ, আকর্ষণীয় ও কার্যকর করতে শিক্ষকগণ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ও প্রযুক্তিগত
সহায়তা গ্রহণ করেন।  শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমকে আকর্ষণীয় ও কার্যকর করা এবং শিক্ষার্থীদেরকে আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ করার লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (Information and Communication Technology - ICT) বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন এবং শ্রেণি কার্যক্রমে তা ব্যবহারের উপর। এই পাঠেশিক্ষাক্ষেত্রে  তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রয়োগের ধারণা, কৌশল, গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জসমুহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
শিখনফল
এই পাঠ শেষে আপনি-
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কী তা বলতে পারবেন
শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রয়োগের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবেন
বাংলাদেশের শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রয়োগের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করতে পারবেন

শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ বর্ণনা করতে পারবেন।

 

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) বলতে সাধারণতঃ  তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ, প্রক্রিয়াকরণ, উৎপাদন ও বিস্তরণ তথা যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের আধুনিক প্রযুক্তিগত উপকরণ বোঝায়তথ্য আদান-প্রদান ও যোগাযোগের জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিস্কৃত হচ্ছে, তবে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত উপকরণগূলোর মধ্যে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয় সিস্টেম, মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের জাতিয় শিক্ষানীতি ২০১০ –এ তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে, “তথ্যপ্রযুক্তিকে শুধুমাত্র কম্পিউটারের মধ্যে সীমিত না রেখে মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন, নেটওয়ার্কিং কিংবা সকল তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের ব্যপক অর্থে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ” করতে হবে। শিক্ষানীতিতে এইসকল তথ্যপ্রযুক্তির হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের উপর গুরুত্ব দিয়ে তা শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশনা রয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ

শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির(ICT) অন্তর্ভূক্ত করার নানাবিধ প্রয়াস দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের নাগরিকদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাক্রমে ICTঅন্তর্ভূক্ত করেছে। আবার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আকর্ষণীয় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করা যায় যার সাহায্যে শিক্ষার্থীরা সহজে ও আনন্দের সাথে শিখতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে ICT -র বহুবিধ প্রয়োগকে তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন- ১) ICT জানা ও আয়ত্ব করা; ২) ICTব্যবহার করে শেখা; এবং ৩) ICT নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা 
১। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি জানা ও আয়ত্ব করা (Learning about ICT): UNESCO কর্তৃক গঠিত International Commission on Education for Twenty-First Century-এর প্রতিবেদনে ICT-কে একবিংশ শতাব্দীর জন্য একটি আবশ্যকীয় দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রস্তুত করার লক্ষ্য থেকে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের শিক্ষাক্রমে নতুন বিষয় হিসেবে ICT অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বাংলাদেশের জাতিয় শিক্ষাক্রম-২০১২ –এ মাধ্যমিক স্তরে একটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তির বহুমুখি ব্যবহার, এর বিভিন্ন অংশের পরিচয়, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের ধারণা ইত্যাদি পাঠ্য বিষয়ে সংযুক্ত করা হয়। আবার উচ্চ শিক্ষা স্তরে জ্ঞানের পৃথক ক্ষেত্র হিসেবে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অধ্যয়নের সুযোগ করা হয়েছে। 
২। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শেখা (Learning with ICT):শিক্ষণ-শিখন (teaching-learning) কার্যক্রমকে আকর্ষণীয় ও কার্যকর করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে ICT ICT ব্যবহার করে আকর্ষণীয় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করা যায়, যা গতানুগতিক শিক্ষা উপকরণের চেয়ে যথেষ্ট কার্যকর। শিক্ষকগণ ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে সফলভাবে শ্রেণিতে পাঠদান করতে পারেন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেণিকক্ষ ও পাঠ্য পুস্তকের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যপী জ্ঞানের সন্ধান করতে পারে। আবার ICT-র সাহায্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের (যেমনঃ প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক) জন্য বিভিন্ন Computer Assisted Learning (CAL) Computer Assisted Instruction (CAI) সফটওয়্যার  প্রস্তুত করা যায়ফলে বিশ্বব্যাপী সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে ICTগুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
৩। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা (Learning through ICT):ICT -র কল্যাণে শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে; এখন যেকোন মানুষ যেকোন সময় যেকোন স্থান (anyone, anytime, anywhere) থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে। বাংলাদেশে বসেও এখন একজন শিক্ষার্থী চাইলে আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স করতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে ICT-র বহুমূখী সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে। বাস্তবে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে মুখোমুখী না দেখেও বরং ইমেইল, চ্যাটিং, ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সাহায্যে পাঠ গ্রহন করতে পারেন। অনলাইনে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন করে সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারে। আর এই ব্যবস্থাকে সহজভাবে Virtual Learning Environment (VLE)বলা হয়। এই ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে এবং বর্তমানে বিভিন্ন দেশে Virtual University, Virtual Library, Virtual Museum ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জাতিয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ অনুরুপভাবে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে (বাঊবি) পর্যায়ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অন্তর্ভূক্তির গুরুত্ব
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অন্তর্ভূক্তির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে জাতিয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ও ২০১০ সালে জাতিয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয় যেখানে শিক্ষার সকল স্তরে ICT-কে অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে জাতিয় শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-কে আবশকীয়  বিষয় হিসেবে মাধমিক স্তরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
জাতিয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ –এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, “আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার পরিধি এবং মান দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা; শিক্ষার সর্বস্তরে এবং সরকারি পর্যায়ে কম্পিউটার সাক্ষরতা নিশ্চিত করা; যথোপযুক্ত গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতা উৎসাহিত করা; মেধাসম্পদ সৃষ্টি করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে আইসিটি আত্মীকরণ।”  উক্ত নীতিমালায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে আইসিটি কোর্স অন্তর্ভূক্ত করে দেশব্যাপী আইসিটি সাক্ষরতা সম্প্রসারণ করার উপর জোর দেয়া হয়েছে এছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র এবং শিক্ষকদের ব্যয়-সাশ্রয়ী উপায়ে আইসিটি-তে স্বাক্ষরতা নিশ্চিত করা এবং এই উদ্দেশ্যে পর্যায়ক্রমে সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উপযুক্ত কারিগরি সহায়তা সহকারে ল্যান এবং ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছেসেইসাথে গণ সাক্ষরতা এবং আজীবন শিক্ষাসহ প্রতিবন্ধী এবং বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে ICT-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করা হয়েছে
জাতিয় শিক্ষাক্রম ২০১২ উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা অনুসরন করা হয়েছে তার অন্যতম একটি নীতি হলো, “আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা” এবং সেখানে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যর একটি হলো “শ্রেণি কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা”।  উক্ত শিক্ষাকরমের ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ অংশের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, “শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসী, উৎপাদনশীল এবং সৃজনশীল হিসীবে তৈরি করা।“ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য বর্ণিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যসমূহ হল:
১। শিক্ষার্থীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অসীম সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত করে বিশ্বের জ্ঞান ও তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশের দরজা উম্নুক্ত করে দেওয়া।
২। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাবে ক্রমবর্ধমান পরিবর্তেনের প্রতি ইতিবাছক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ সাধন করা।
৩। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের সমর্থ করা।
৪। ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, মেধা ও সৃজনশিলতার বিকাশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা।
৫। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি অনুধাবনে সক্ষম করা।
৬। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিক আচরণের অভ্যাস  গড়ে তুলতে সহায়তা করা।
৭। বেকারত্ব নিরসন, দারিদ্র্য বমোচন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত করা।
সুতরাং দেখা যাছে যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গৃহীত নীতিমালা এবং পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থী সকলকেই তাই গুরুত্ব সহকারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-কে গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ
ICTশিক্ষাক্ষেত্রে যেমন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, তেমন নতুন চ্যালেঞ্জ-এর সম্মুখীন করে দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জসমূহ নিম্নরুপ।
ক) ডিজিটাল ডিভাইড:  ICTজানা এবং ICT না জানা মানুষের মধ্যে যে বিভাজন, তাকে Digital Divide বলা হয়। ICT সমগ্রির মূল্য এখনও সর্বসাধারণের সামর্থের মধ্যে না থাকায় দেশের সকল মানুষের পক্ষে ICTসমগ্রী ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে সবাই সমানভাবে ICTব্যবহার করতে পারছে না। যারা ICT জানে না তাদের তুলনায় ICTজানা মানুষেরা কর্মক্ষেত্র, ব্যবসায়-বানিজ্য, সরকারি সেবা গ্রহণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা পেয়ে থাকে। এর ফলে এই দুই ধরণের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পার্থক্য বা বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এই বৈষম্য দূর করার চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতে হয় এর জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে, যেমনঃ ICTসামগ্রীর উপর কর প্রত্যাহার এবং ভর্তুকি প্রদান, ICTক্রয়র জন্য বিষেশ শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা করা, বিনামূল্য ICTসেবা পাওয়ার জন্য  ই-তথ্য সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি।
খ) অপ্রতুল বাজেট: ICT সমগ্রীর উচ্চমূল্যের তুলনায় বিদ্যালয়ের শিক্ষা বাজেট অপর্যাপ্ত হওয়ায় বিদ্যালয়গুলো তাদের প্রয়োজন আনুযায়ী তা ক্রয় করতে পারে না। বিদ্যালয়গুলোতে একটি কম্পিউটারে একাধিক শিক্ষার্থীকে কাজ করতে দেখা যায়। আবার নানা কারণে ICT সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেলে তার মেরামত খরচও বেশী হওয়ায় অনেক সময় সেগুলো অকেজো অবস্থায় পরে থাকে। শিক্ষাক্ষেত্রে ICT–র সফল প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন প্রর্যাপ্ত শিক্ষাবাজেট, কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় তা সম্ভব হয়ে উঠে না।
গ) জেন্ডার সমতা: বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায়  মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কম আগ্রহী। মেয়েদের এই অনগ্রসরতা ICT-র ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। সুতরাং মেয়েদেরকে ICTশিক্ষায় আগ্রহী করা ও ICT ব্যবহারে দক্ষ করা একটি চ্যলেঞ্জ হিসেবে প্রতিয়মান।

ঘ) নকল প্রবণতা:অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সরাসরি কপি-পেস্ট করে তাদের এসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজ প্রস্তুত করে এবং তথ্যের উৎস উল্লেখ করে না। এটা একধরণের নকল করা, যাকে online Plagiarism বলা হয় এবং এটা অনৈতিক কাজ। ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবহার করাতে আপত্তি নেই, কিন্তু অবশ্যই তার মূল লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষার্থীরা মূল লেখকের নাম উল্লেখ না করে অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেয়, যা একধরণের নকল প্রবণতা এবং অনুচিত কাজ
ঙ) নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা: ইন্টারনেটের প্রসারের সাথে সাথে নতুন নতুন অপরাধ ও অনৈতিক কাজের ব্যপকতা বাড়ছে, যেমন: অন্যের গোপন তথ্য চুরি করা (Hacking), অন্যের কম্পিউটারে অনাকাঙ্খিত প্রোগ্রাম প্রবেশ করিয়ে ক্ষতি করা (Computer Virus), অন্যকে ভয়ভীতি দেখানো, পর্ণগ্রাফি ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। এই ধরণের কাজগুলি অনৈতিক এবং বিভিন্ন দেশে আইন করে এগুলিকে আপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  এগুলিকে সাধারণভাবে Cyber Crime বলা হয়। এই ধরণের সাইবার ক্রাইম (বিশেষতঃ Computer Virus) এর কারণে বিদ্যালয়ের কম্পিউটারগুলি অনেক সময় অকেজো হয়ে পড়ে। সাইবার ক্রাইম থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরণের অনলাইন সিকিউরিটি ও এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার পাওয়া যায়, কিন্তু এগুলি ব্যয়বহুল বিধায় বিদ্যালয়ের স্বল্প বাজেটের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ক্রয় করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
চ) বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সুবিধা প্রদান: স্বাভাবিক শিশুদের কথা মাথায় রেখে সাধারণতঃ ডিজিটাল কনটেন্ট বা শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু সমাজের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের (যেমনঃপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশু) শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে ICT-র ব্যবহার বাড়াতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহয়তা এবং যথাযথ গবেষণাকর্ম সম্পাদন করতে হবে।
ছ) শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষায় ICT-র সফল প্রয়োগের মূল ভূমিকা রাখবেন শিক্ষকগণ। কিন্তু ICT অপেক্ষাকৃত নতুন একটি প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকগণ ICT-তে দক্ষ নন। সেকারণে শিক্ষায় ICT-কে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকগণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল যে, ICTদ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং নিত্যনতুন ICT-দক্ষতার সাথে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য ঘনঘন প্রশিক্ষণের আয়োজন করা ব্যয়সাপেক্ষ। শিক্ষকগণ স্বেচ্ছায় নিজেদের দক্ষতার উন্নয়ন না ঘটালে সরকারের একার পক্ষে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন।
উপসংহার ও সুপারিশ
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অন্তর্ভূক্ত করার বিকল্প নেই। শিক্ষার মাধ্যমে শুধু ICT-দক্ষতা অর্জন করা নয়, বরং ICT-র প্রয়োগ ঘটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন করার সময় এসেছে। সরকার এই বিষয়ে বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহন করেছে এবং শিক্ষাক্রমেরও পরিমার্জন করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ICT-র সফল বাস্তবায়নের জন্য জাতিয় শিক্ষাক্রম-২০১২ নিম্নরুপ সুপারিশ করেছেঃ
১। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ম্যানুয়াল তৈরিপূর্বক প্রতিটি বিদ্যালয়ে  নূন্যতম একজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান।
২। প্রতিটি বিদ্যালয়ে নূন্যতম ৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১টি করে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করণ এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সরবরাহ।
৩। স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যন্ত্রাংশ/যন্ত্রপাতি সরকারি পর্যায়ে সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ের আইসিটি ল্যাবে প্রদান।
 ৪। ক্লাসগূলো কম্পিউটার ল্যাব বা আইসিটি ল্যাবে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।
৫। প্রতি বিদ্যালয়ে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ল্যাব সহকারী নিয়োগের ব্যবস্থা।
৬। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ইন্টারনেটের সংযোগ প্রদান।
৭। আইসিটি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ।
তথ্যসূত্রঃ
১। জাতিয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ।
২। জাতিয় শিক্ষানীতি-২০১০, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ।
৩। জাতিয় শিক্ষাক্রম-২০১২, জাতিয়  শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ।
৪। Roblyer, M. D., & Doering, A. H. (2010). Integrating educational technology into teaching (5th ed.). New York: Allyn & Bacon.
৫। Chowdhury, M. A. A. (2012). Teacher educators’ perspectives of the introduction of ICT in education in Bangladesh, Critical Literacy: Theories and Practices, 6(2), 66-85. (www.criticalliteracy.org.uk)
৬। Chowdhury, M. A. A. (2013). Integrating ICT in Teacher Education: Benchmarks for teachers' professional development in Bangladesh. In J. Greenwood, J. Everatt, A. H. Kabir & S. Alam (Eds), Research and Educational Change in Bangladesh (pp. 173.188), Dhaka: University of Dhaka Press.
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

0/Post a Comment/Comments