অপরাজেয় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তা

আবদুল গাফফার চৌধুরী 

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর শক্তি ও একতা সম্পর্কে প্রয়াত গণতান্ত্রিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার বলেছিলেন, ‘শূন্য যোগ শূন্য যোগ শূন্যের যোগফল হলো শূন্য।’ তার এই মন্তব্য শুনে তার বিরোধী পক্ষ প্রচার শুরু করেছিল, সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোটা মুসলিম বিশ্বের অবমাননা করেছেন। ইসলামের শক্তি এবং ইসলামি রাষ্ট্রগুলো এখনো শক্তিশালী। তাদের মধ্যে ঐক্য আছে। প্রমাণ হিসাবে তারা আরব লীগের নাম উল্লেখ করেছিলেন। এটা গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কথা। তখন ইসরায়েলের অবৈধ সম্প্রসারণ শুরু হয়েছে। একের পর এক আরব ভূমি তারা হামলা চালিয়ে দখল করে নিচ্ছিল।শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মন্তব্যের সমর্থনে এবং তার বিরোধী মহলের সমালোচনা খণ্ডন করে দৈনিক ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে মোসাফির তার বক্তব্য হাজির করেছিলেন। মোসাফির আর কেউ নন। ছিলেন ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। আমি তখন ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি এবং ছিলাম মানিক মিয়ার কলামের অন্যতম অনুলেখক। ৫০ বছরের বেশি সময় আগের মানিক মিয়ার লেখার হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারব না। কিন্তু তার বক্তব্য নিজের ভাষায় এখানে তুলে ধরতে পারব।



রাজনৈতিক মঞ্চে মোসাফির লিখেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে প্যালেস্টাইনি আরব ও আরব দেশগুলো বারবার পরাজয়ে এ কথাই কি প্রমাণিত হয় না যে, ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরবেরা কত শক্তিহীন? মিশর যখন একা ইসরায়েলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক প্রভৃতি মুসলিম দেশ তা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এলে ইসরায়েলের আগ্রাসন এতটা দুঃসাহসী হতে পারত না এবং আরবেরা তাদের ঘর বাড়ি ভূমি ক্রমাগত হারাত না। শহীদ সাহেব আরব বিশ্বের এই অনৈক্য ও শক্তিহীনতার কথাই বলেছেন, ইসলামের শক্তিহীনতার কথা বলেননি।

মানিক মিয়া অথবা মোসাফিরের এই মন্তব্যের পর প্রায় ষাট বছর কেটে গেছে। ষাট বছর পরেও ইসরায়েল হামলা চালিয়ে গাজা ধ্বংস করেছে। কিন্তু মুসলমান দেশগুলোর একটিও প্যালেস্টাইনি মুসলামানদের সমর্থন দানে এগোয়নি। এখন আরব বিশ্ব দুর্বল নয়। ইসলায়েল যেমন মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত, তেমনি সৌদি আরব এবং পাকিস্তানও মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত। তদুপরি পাকিস্তানের হাতে আণবিক অস্ত্র আছে। কিন্তু তারা ইসরায়েলকে প্রতিহত করার বদলে ইহুদি রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি করেছে। গাজায় সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার সময় প্রমাণ হয়েছে আরব দেশগুলোর এখন শক্তি আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই।

এই ঐক্য না থাকার কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে হয় রাজতন্ত্র, নয় স্বৈরতন্ত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনগণের প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে, এই সব দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক ঐক্য থাকলেও তা ইসরায়েলকে প্রতিহত করতে এগিয়ে যেত। বর্তমান শাসকেরা জনগণের প্রতিনিধি নয় এবং নিজেদের গদি রক্ষাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়ায় ইসরায়েল পবিত্র আল আকসা মসজিদ দখল করে নেওয়ার পরেও বিপন্ন ইসলাম রক্ষায় ইসলামি দেশগুলোর শাসকদের কোনো উদ্যোগ নেই।

ইউরোপের এক যুদ্ধে ভারতের মহাত্মা গান্ধী স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আফগান ও গালফ যুদ্ধসহ এতগুলো যুদ্ধ হলো, বাংলাদেশে জামায়াত, হেফাজত—যারা প্রতিদিন ইসলাম বিপন্ন বলে হাঁক দেয় এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার ডাক দেয়, তাদের কাউকে কখনো প্যালেস্টাইনি মুসলমানদের সাহায্যের জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবক পাঠাতেও দেখাযায়নি। তাতেই বোঝা যায়, এদের ইসলামপ্রীতি কতটা ফাঁকা।

ইসলামকে একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধের পর খাড়া করতে চেয়েছিলেন আফগানিস্তানের জামালুদ্দিন আফগানি। তার আন্দোলনের নাম ছিল প্যান ইসলামিক মুভমেন্ট। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যশক্তি এই আফগানির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাকে আফগানিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি পাগলের মতো একটির পর আরেকটি দেশে গেছেন। কোনো দেশ তাকে আশ্রয় দেয়নি। এমনকি সৌদি আরবেও নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্যান ইসলামিক মুভমেন্টকে ধ্বংস করে দেয়।

ধর্ম কোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না এবং রাষ্ট্রীয় দর্শন হতে পারে না—এ উপলব্ধি থেকে মিশরের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট নাসের ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদ প্রচার করেছিলেন এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সাড়া সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশেও অনুরূপভাবে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচার দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।

এই জাতীয়তার শক্তি এখনো অপরাজেয়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেখা গেল সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, উজবেকিস্তান প্রভৃতি দেশ স্বতন্দ্র জাতি-রাষ্ট্রের অবস্থান গ্রহণ করেছে। ধনবাদের পাহারাদার গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দাপটের যুগে মনে হয়েছিল জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা ভেঙে যাবে। তা হয়নি, বরং বিশ্বায়ন বা বাজার অর্থনীতি এখন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা ও সংখ্যা বাড়ছে। যুক্তরাজ্য থেকে স্কটল্যান্ড বেরিয়ে যেতে চাইছে। আমেরিকার কোনো কোনো রাজ্যেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে।

বিশ্বের জাতীয়তাবাদের শক্তি বাড়ছে। জাতি-রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ পতনের মুখে। আমেরিকায় ট্রাম্প যুগের অবসানে যে নতুন প্রেসিডেন্ট (জো বাইডেন) ক্ষমতায় এসেছেন তিনি সময়ের পরিবর্তন বুঝতে পেরেছেন। তিনি প্যালেস্টাইনি আরবদের স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি সঙ্গত এবং বর্তমান বিরোধের মীমাংসার উপায় বলে মন্তব্য করেছেন|

অনেকে মনে করেন, স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কালক্রমে এই রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য আরব মুসলিম দেশের চাইতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের মৈত্রী ও সহযোগিতা অনেক বেশি হবে। কারণ, একমাত্র ধর্ম ছাড়া ইসরায়েলের ইহুদি এবং প্যালেস্টাইনের আরবদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতিও অভিন্ন। ইসরায়েল জঙ্গি ফ্যাসিস্ট নেতাদের কবলমুক্ত হলেই ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ এই দুই দেশের মানুষের মৈত্রী গড়ে তুলবে।

এ কথা আমাদের উপমহাদেশ সম্পর্কেও সত্য। ধর্ম দ্বারা যে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে যে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে, সেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী ও সহযোগিতা গড়ে উঠেছে। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সেই মৈত্রী এখনো গড়ে ওঠেনি। কট্টর তালেবানি দেশ আফগানিস্তান। তার মৈত্রী ও সহযোগিতাও ভারতের সঙ্গে। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বিরোধ এখনো দূর হয়নি।

ভারতে মোদি সরকার একটি ভুল পথ ধরেছে। তারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অমুসলমানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেবেন ঘোষণা করেছেন। এই তিন দেশের মুসলমানদের এই নাগরিত্ব পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। নাগরিকত্ব প্রদানে এই ধর্মীয় বৈষম্য সৃষ্টি দ্বারা মোদি ‘হিন্দু ভারত’ তৈরি করতে পারবেন না। বরং এই হিন্দু ভারত গঠনের চেষ্টা ভারতের জন্য পাকিস্তানের পরিণতি ডেকে আনবে।

লন্ডন, ২৯ মে, শনিবার, ২০২১

0/Post a Comment/Comments