বাংলা পত্র লিখন | চিঠি লেখার নিয়ম বা পদ্ধতি | চিঠির প্রকারভেদ | চিঠির মোট কতটি অংশ | একটি বাস্তন চিঠির উদাহরণ (বাবার কাছে মেয়ের চিঠি)


 

বাংলা পত্রলিখন

আমাদের ব্যবহারিক জীবনে চিঠিপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা প্রয়োজনে আমাদেরকে চিঠি লিখতে হয়। আত্মীয়, বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সংবাদ আদান- প্রদানের মাধ্যম হিসেবে  চিঠির রয়েছে গুরযুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অফিস-আদালতে ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ অনেকাংশে চিঠিপত্রের ওপরই নির্ভরশীল। সম্প্রতি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত চিঠি লেখার গুরুত্ব কিছুটা কমেছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য চিঠি লেখার প্রয়োজন একটুও কমেনি। চিঠি লেখার প্রয়োজন আমাদের সংস্কৃতির এক অনুষঙ্গী উপাদান। যোগাযোগ এবং ভাববিনিময়ের এক অনুপম মাধ্যম হিসেবে চিঠি লেখার এই রীতি অব্যাহত থাকবে। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ গাছের পাতায়, গাছের ছালে, চামড়ায়, ধাতব পাতে লিখত। পাতায় লিখত বলেই এর নাম ‘পত্র’। সুন্দর, শুদ্ধ চিঠির মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা, রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। সুলিখিত চিঠি অনেক সময় উন্নত সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’।

চিঠির প্রকারভেদ

বিষয়বস্তু প্রসঙ্গ ও কাঠামো অনূসারে বিভিন্ন ধরনের পত্রকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:

ক. ব্যক্তিগত চিঠি

খ. আবেদনপত্র বা দরখাস্ত

গ. সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি

ঘ.মানপত্র ও স্মারকলিপি

ঙ. বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িকপত্র

চ. আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণপত্র ।

চিঠি লেখার অনুসরণীয় পন্থা

চিঠি যে ধরনের হোক না কেন, তা লেখার সময় কয়েকটি দিক বিবেচনায় রাখা দরকার:

১. বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গের ওপর চিঠির কাঠামো নির্ভর করে। ব্যক্তিগত চিঠি আর ব্যবসায়িক পত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই এক-একরকম পত্রের জন্য এক- একরকম পদ্ধতি, ভাষাভঙ্গি অনুসরণ করতে হয় ।

২. চিঠির মাধ্যমে মানুষের রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। তাই অস্পষ্ট এবং কাটাকাটি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

৩. ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।নির্ভুল বানান ,যথাযথশব্দ এবং বাগাড়ম্বরহীন বাক্য ব্যবহারের উপর চিঠির মান নির্ভর করে। ভুল বানান, এলোমেলো বাক্য অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি করে। তা পত্র লেখক সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দিতে পারে।

চিঠি নিজের হওয়া চাই। অর্থাৎ নিজস্ব অভিজ্ঞতা,অনূভুতি,অভিরুচি,ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ থাকতে হবে।পাঠ্যবইতে নমুনাচিঠি ধারণা তৈরী করার জন্য দেওয়া হয়। তা হুবহু মূখস্থ না করে, পাঠ্যবইয়ের নমুনা অনুসরণ করে চিঠিতে নিজস্বতা আনা উচিত ।


চিঠির বিভিন্ন অংশ

একটি চিঠি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত :

ক. শিরোনাম

খ. পত্রগর্ভ

শিরোনাম অংশে চিঠির খামের ওপর বামদিকে প্রেরকের ঠিকানা ও ডানদিকে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে হয় ।বর্তমানে সরকারী পোষ্ট অফিসে প্রাপ্ত খামের সামনের অংশে প্রাপকের ঠিকানা লেখার নির্দিষ্ট ছক এবং পেছনের অংশে প্রেরকের ঠিকানা লেখার আলাদা ছক রয়েছে । পত্রগর্ভ হচ্ছে চিঠির ভেতরের অংশ ।

ব্যক্তিগত চিঠি:

ব্যক্তিগত চিঠির কাঠামোতে ছয়টি অংশ থাকে। নিচে প্রদর্শিত ছকের মাধ্যমে ছয়টি অংশ তুলে ধরা হয়েছে –

চিঠির ছক

[১. মঙ্গলসূচক শব্দ]
২.স্থানও তারিখ
৩.সম্বোধন
৪. মূল বক্তব্য
৫. পত্র –লেখকের স্বাক্ষর

     ৬. শিরোনাম

প্রেরক-

নাম:…………………..………

ঠিকানা:……………………..

ডাক টিকেট

প্রাপক-

নাম :………………………………..

ঠিকানা :………………………………

১.মঙ্গলসূচক শব্দ :

এককালে ব্যক্তিগত চিঠির মাধ্যমে কাগজের পৃষ্ঠার মাঝামাঝি জায়গায় পত্রলেখক নিজে ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মঙ্গলসূচক শব্দ লিখতেন ।

মুসলমানরা লিখতেন : এলাহি ভরসা, আল্লাহ সহায়,হাবিব ভরসা,থোদা ভরসা,বিসমিল্লাহহির রাহমানির রাহিম ইত্যাদি ।

হিন্দু ধর্মবলম্বীরা লিখতেন: ওঁ, ওঁমা, শ্রী, শ্রী দুর্গা সহায় , শ্রীহরি ইত্যাদি। এটা লেখা না – লেখা ব্যক্তিগত অভিরুচির ওপর নির্ভরশীল। আজকাল ব্যক্তিগত চিঠিতে এগুলো আর লেখা হয় না ।

২.স্থান ও তারিখ:

চিঠির ডানদিকে তারিখ এবং যে স্থানে বসে পত্র লেখা হচ্ছে তার নাম লিখতে হয়।

৩. সম্বোধন:

পত্র লেখার শুরুতে পত্রের বামদিকে প্রাপকের সঙ্গে সম্পর্ক অনুযায়ী সম্বোধন বা সম্ভাষণ লিথতে হয় ।পত্রদাতার সঙ্গে প্রাপকের সম্পর্ক অনূসারে এবং পত্র-প্রাপকের মান,মর্যাদা, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা অনুযায়ী সম্বোধনসূচক শব্দ নির্বাচন করতে হয়।ধর্ম–সম্প্রদায় অনুসারে এই সম্বোধন বা সম্ভাষণসূচক শব্দের পার্থ্যক্য হতে পারে । যেমন :

ব্যক্তিগত পত্রের সম্ভাষণ রীতি :

শ্রদ্ধাভাজন(পুরুষ):

শ্রদ্ধাস্পদেষু,পরম শ্রদ্ধাভাজন,মাননীয়,মান্যবরেষু,মান্যবর,শ্রদ্ধাভাজনেষু ইত্যাদি।

শ্রদ্ধাভাজন (মহিলা):

মাননীয়া, মাননীয়াসু, শ্রদ্ধেয়া, শ্রদ্ধাস্পদাসু ইত্যাদি ।

সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি :

সুধী, মান্যবর, সৌম্য ইত্যাদি ।

সমবয়স্ক প্রিয়জন/বন্ধু (মহিলা) :

সুচরিতাসু, প্রীতিভাজনীয়াসু, প্রীতিনিলয়াসু, সুহৃদয়াসু ইত্যাদি ।

বয়:কনিষ্ঠ (ছেলে):

কল্যাণীয়া, কল্যাণীয়াসু, স্নেহাস্পদেষু, স্নেহভাজনেষু স্নেহের প্রিয়, প্রীতিভাজনেষু, প্রীতিনিলয়েষু

বয়:কনিষ্ঠ (মেয়ে) :

কল্যাণীয়া, কল্যাণীয়াসু স্নেহের, স্নেহভাজনীয়া, স্নেহভজনীয়াসু ইত্যাদি ।

৪. মূল পত্রাংশ (মুল বক্তব্য )

এই অংশে পত্রলেখকের মূল বক্তব্য, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতি, ঔসুক্য ইত্যাদি লিখতে হয়। সহজ, সরলও হদয়গ্রাহী করে লেখার ওপরই চিঠির সার্থকতা নির্ভর করে। রচনার গুণেই চিঠি উৎকৃষ্টও শিল্পনিপুণ হয়ে ওঠে। চিঠির পূর্বপর বক্তব্যের সামঞ্জস্য, সংগতি ও ধারবাহিকতা যেন রক্ষা হয়,সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

এ জন্য বক্তব্যকে প্রয়োজন মতো অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে লিখলে ভালো। যেমন: প্রথম অনু্চ্ছেদে সালাম ও শুভেচ্ছা  জানিয়ে চিঠি লেখার করণ ও পটভুমি তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইচ্ছা ও অভিপ্রায় প্রকাশ এবং প্রয়োজনে বক্তব্যকে আরো বিস্তার ঘটিয়ে সমাপ্তি টানা যেতে পারে। ব্যক্তিগত চিঠি আন্তরিকতাপূর্ণ এবং হৃদয়সাপর্শী হতে হয়।পত্রের শেষের দিকে পত্র-সমাপ্তিসূচক বিদায় সম্ভাষণ জানানোর রীতি সৌন্দর্যের পরিচায়ক। পত্র-সমাপ্তিসূচক শব্দ হিসেবে সাধারণতি ইতি, নিবেদন- ইতি ইত্যাদি লেখাই দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত। তবে এখন ইতি না লিখে শুভেচ্ছান্তে, ধন্যবাদান্তে, ধন্যবাদসহ, সালামান্তে, প্রণামান্তে, নিবেদনান্তে ইত্যাদির প্রয়োজন ও অভিরুচি অনুযায়ী ব্যবহৃত হয় ।

পত্র-সমাপ্তিসূচক অভিব্যক্তির পর বিদায় সম্ভাষণ হিসেবে পত্র-প্রাপকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক অনুযায়ী বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। স্থান, কাল, পাত্রভেদে পত্র-প্রাপকের সঙ্গে সম্পর্ক অনুসারে বিশেষণ ব্যাবহারের পার্থক্য দেখা যায় ।

প্রাপক শ্রদ্ধাভাজন (পুরুষ):

স্নেহধন্য, স্নেহাকাড়ী, প্রীত্যর্র্থী, গুণমুগ্ধ, প্রণত, বিনীত, প্রীতিধন্য, প্রীতিস্নিগ্ধ ইত্যাদি।

প্রাপক শ্রদ্ধাভাজন:

(পত্রলেখক মহিলা) স্নেহধন্যা, স্নেহাকারী, প্রণতা, বিনীতা, গুণমুগ্ধ, প্রীতিধন্যা, প্রীতিস্নিগ্ধা ইত্যাদি।

প্রাপক অনাত্মীয় সম্মানীয় লোক:

(পত্রলেখক পুরুষ) নিবেদক, ভবদীয়, বিনীত, বিনয়াবনত, ইত্যাদি ।

        :(পত্রলেখক মহিলা) নিবেদিকা, বিনীতা, বিনয়বনতা ইত্যাদি ।

প্রাপক বন্ধুস্থানীয় বা প্রিয়ভাজন:

(পত্রলেখক পুরুষ) প্র্রীতিধন্য, প্রীতিমুগ্ধ, অভিন্নহৃদয়, আপনারই, তোমারই ইত্যাদি ।

প্রাপক বয়সে ছোট হলে :

আশীর্বাদক, আশীর্বাদিক, শুভাকাঙ্খী, শুভানুধ্যয়ী ইত্যাদি ।

বিদায় সম্ভাষণ সাধারণত পত্রের ডানদিকে লিখতে হয় ।

৫. নাম –স্বাক্ষর (পত্রলেখকের স্বাক্ষর )

নাম স্বাক্ষর চিঠিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তাই চিঠির শেষে অবশ্যই স্বাক্ষর করতে হয় । মা- বাবা, নিকট আত্মীয় ,ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে চিঠি লিখতে গিয়ে পুরো নাম না লিখে সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর বা ডাক নাম ব্যবহার করাই সংগত । নাম স্বাক্ষরের আগে কেউ কেউ ‘তোমার পুত্র’, ‘তোমার প্রিয় মুখ’,  ‘ তোর ‘বন্ধু’ ইত্যাদি পরিচিতি লিখে তারপর নাম – স্বাক্ষর করে ।

৬. শিরোনাম :

শিরোনাম পত্র পাঠাবার খামের ওপর লিথতে হয় । খামের ওপর বাম দিকে পত্রলেখকের ঠিকানা এবং ডানদিকে পত্র প্রাকের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা স্পষ্ট করে লিখতে হয়। খামের ওপরে ডান কোণে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মূল্যের ডাক টিকেট লাগাতে হয়। আজকাল বড় বড় পোষ্ট অফিসে ডাকটিকেটের পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে খামের ওপর ছাপ মারার ব্যবস্হা চালু হয়েছে ।

ক. ব্যক্তিগত চিঠি

১.বাবার কাছে মেয়ের চিঠি ।

                                                   ০২.১০.২০১২

                                                   সদর রোড, বরিশাল

শ্রদ্ধেয় বাবা,

আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম নেবেন। মাকেও আমার সালাম জানাবেন। শবনম বুবলি ও ছোট্টভাই শাকিব খানের প্রতি রইল অশেষ স্নেহ।

সেদিন বাস স্টপে আপনার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ভালোভাবেই বরিশাল এসে পেীছেছি। যদিও সারা পথ বাড়ির কথা ভেবে মন খারাপ লেগেছে। আগামি ১০ই নভেম্বর থেকে আমাদের প্রাক–নির্বাচনী পরীক্ষা। তাই পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বাবা, আপনার স্বপ্ন আকাঙ্খার কথা আমার মনে আছে। আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন, যেন আমি ভালো ফল করে আপনার মুখ উজ্জ্বল করতে পারি। মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। খোদার অশেষ কৃপায় আমি ভালো আছি। আপনি আমার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেবেন। চিঠিতে আপনাদের খবর বিস্তারিত জানাবেন।

ইতি

আপনার স্নেহধন্য

অপু ইসলাম খান

প্রেরক

অপু ইসলাম খান

সদর রোড, বরিশাল

 

                                       [ডাক টিকিট]

  প্রাপক

নাম : অধ্যাপক জাকির হোসেন

গ্রাম : হোসনাবাদ

পোষ্ট :হোসনাবাদ

গৌরনদী, বরিশাল

0/Post a Comment/Comments