ব্যবধান

ইশরাত ফেরদাউস


তখন ঘাস ফড়িংয়ের জীবন আমার। সদ্য ওড়া পাখির ছানার মতো ডানা মেলছি, যদিও বয়স অনুপাতে পর্যাপ্ত ম্যাচুইরিটি ছিলোনা তখনো। একটু আধটু অকবিতা লিখতাম। আর টেবিল ভর্তি বই ছিলো টেক্সট বইয়ের চেয়েও বেশি। সবাই বলতো এসব কবিতা না আউড়িয়ে চাকুরির পড়াশুনায় মন দাও, কবিতা ভাত দিবেনা। 
কিন্তু আমার পেশাদার লেখক হওয়ার ইচ্ছে কোনো কালেই  ছিলোনা বা এখনো নেই। দু'চার লাইন লিখা ছিলো শখ কিংবা মনের অনুভূতি।

এমনি গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি গজানো সময়ে শিশিরের সাথে আলাপ। কুঁড়ি গজানোর উপযুক্ত সময় হলেও তার সাথে আমার পরিচয় টা হলো বড্ড অসময়ে। তার উর্বর কথাবার্তা, হাসি, প্রাণবন্ত ভাব সবই ছিলো মুগ্ধ হওয়ার মতো! আমাদের মাঝে ছিলো দুস্তর ব্যবধান। ঠিক বয়স থেকে - সে আমার চেয়ে আট বছরের বড়! কখনো তাকে দেখিনি প্রত্যক্ষভাবে। কিন্তু আমি বারবার মুগ্ধ হয়েছি তার প্রতি। আমি যে রাগি ও একগুঁয়ে অথচ তার কাছে আমি সহজ হয়ে যেতাম,, ধীরে ধীরে এটা একটা উইক পয়েন্ট হয়ে যায়। সে ডিফেন্সে জব করতো প্রচন্ড ব্যস্ততায়ও আমাদের কথা হতো, ঐ অল্প সময় টুকু আমার কাছে সেরা গিফট মনে হতো।
 
অনেক সময় গড়িয়ে যায়, পরস্পরের জানা হয় অতীত বর্তমান। আমি হোঁচট খেতে থাকি বারবার। ঠিক কথায় বুঝে যাই আমাদের সুন্দর সম্পর্ক পরিণতিহীন। আর আমি তখন লিখেছিলাম-
"তোমার শহর ছেড়ে কয়েকশো মাইল দূরে, 
চলে যাবো হেমলক বনে।"

সে আমায় বলতো তুমি আমার বস হবে। আর আমি অস্থির হয়ে থাকতাম তাকে হারানোর শংকায়। যে আমাকে একদিন বলেছিলো- মেয়েরা ছ্যাকা খেলে কিছু হলেই বলে বিদেশে চলে যাবো দেশে আর থাকবো না। অথচ দেখি পরে বিয়ে করে বর নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে দিব্যি ঘর সংসার করে। তুমি কি করবে সংসার না পড়াশুনা তুমিই ভেবে দেখো। আর এদিকে আমি ক্যারিয়ার নিয়ে হোঁচট খেতে থাকি। রাগ অভিমানের পালায় আমি একদিন স্যোশাল নেটওয়ার্ক থেকে দূরে সরে যাই। তোমাকে আমি পাবোনা কিন্তু জিদ চেপে বসে আমাকে তোমার বস হতে হবে। না হয় হেমলকে যাবোনা তোমার আশেপাশেই থাকবো।

আমি ছেড়ে দিই আমার লেখালেখি। দৌড়াই ক্যারিয়ার গুছানোর পিছে, ততোদিনে এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে কখনো তুমি আমার হবে দূরে থাক, তোমায় হয়তো চোখের দেখা দেখাও হবেনা। এসব ভাবতেই প্রচন্ড কান্না পায়। দরজা বন্ধ করে কাঁদি আবার পড়ি। প্রায় দুবছর পর আমি স্যোশাল মিডিয়ায় আবার ঢু মারি। আর সার্স লিস্টের উপরে থাকা নামটায় ক্লিক করেই প্রোফাইটা দেখি। সেখানে দুবছরে রিলেশানশিপ স্ট্যাটাস ম্যারিড হয়ে গেছে। আর শিশিরের প্রিয় মানুষটির সাথেই। চোখে জল নিয়ে একটু মুচকি হাসলাম। শুভকামনা বার্তা পাঠাতে গিয়েও ব্যাকস্পেস চেপে ফিরে আসলাম। কারন তার জন্য আমার প্রার্থনা সবসময় আছে।
এই দুবছর পর আবার একটা লাইন লিখলাম- The saddest part in life is saying goodbye! To the person you wish to spend your lifetime with.
দ্যান আউট অফ স্যোশাল মিডিয়া।
 
এরপর আমি শিক্ষা নিয়ে রিসার্চ শুরু করলাম পাশাপাশি লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৌড়। তারও পরে একদিন ফেসবুকে আসা- পূর্বের কিছু অপ্রকাশিত লেখা কালেক্ট করার জন্য। শিশির এখন এক সন্তানের বাবা, কি সুন্দর ফ্যামিলি ছবি।  আজও একটু হাসলাম বুকে চাপা নিঃশ্বাস নিয়ে। 
যে দিন থেকে জেনে গেলাম আমার প্রার্থনা কখনো পূর্ণ হওয়ায় নয় সেদিন থেকে শিশিরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম, তার ব্যস্ততায় হয়তো সেও আর আমাকে মনে রাখেনি।

তিন বছর শেষ। আমার একটা বই বের হলো- না আর গল্প কবিতা নয়। গবেষণা বিষয়ক। এখন একটু একটু পরিচিতি পাচ্ছি সেই সব মানুষদের থেকে৷ একদিন ম্যাসেঞ্জার ওপেন করে দেখলাম শিশিরও একটা বার্তা দিয়েছে- 
" অভিনন্দন বাচ্চা" 
রিপ্লে- ভালোবাসা💚💟 দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। 
ও হ্যাঁ শিশিরকে সবসময় আমি সবুজ ও সাদা লাভ ইমেজ দিতাম কারন-
আমার হৃদয় ক্যানভাসের সবটুকু শুভ্র ভালোবাসা তার জন্য ছিল, যার সবুজ রং কখনো ফ্যাকাসে হবার নয়। 

তারও একবছর পর আমি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে নতুন চাকুরিতে জয়েন করলাম। আজ সবাই খুশি কিন্তু আমি! আমার ভাবনা সেতো ক্ষতবিক্ষত। ভালোবাসাকে খুঁজছি! যে করেই হোক শিশিরের পোস্টিং কোথায় জেনে সেখানেই জব ট্রান্সফার করবো। আর তাকে জবাব দিহি করতে আমার সামনে তলব করে বলবো-
দেখ আজ আমি তোমার বস হয়েছি!
........ হ্যাঁ আমি ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে আমার শিশিরের গন্তব্যে এসেছি, কিন্তু--- কিন্তু শিশির অপারেশনে গিয়ে আর, আর ফিরতে পারেনি! 
আমার শিশির, আমার ভালোবাসা!
.....আমি তো তোমার সাথেই সংসারী হতে চেয়েছিলাম, আর তোমাকে না পাওয়ায় দিনে অন্যভাবে তোমার পাশে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু তুমিই তো আমাকে একা করে চলে গেলে প্রিয় আমার।
 
শিশির! ক্ষণিকের জন্য আমার জীবনে এসেছিলো, যে আমার চিরস্থায়ী অসুখ।
সে আমার শতকোটি বছরের এক বিষাদমাখা আরাধনা!
সে আমার দু'জন্মের না পাওয়া, অধরা। 
সে আমার ভালোবাসার দেবতা।

0/Post a Comment/Comments