নীতিশাস্ত্রের পদ্ধতি

নীতিশাস্ত্রের পদ্ধতি : প্রত্যেক বিজ্ঞান বিশেষ বিশেষ পদ্ধতির সহায়তায় তার আলোচ্য বিষয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করে।নীতিশাস্ত্র বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে তার আলোচ্য বিষয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে।এই পদ্ধতিগুলিকে ৩ টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়,যথা- (১)মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি (psychological method)
(২)বিবর্তনমমূলক পদ্ধতি(genetic method) এবং
(৩)পরাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (metaphysical method)।
(১)মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি (psychological method) :হিউম,বেন্থাম,জে.এস.মিল,বেইন প্রমুখ চিন্তাবিদের মতে,বৈজ্ঞানিক ঘটনাসমূহ আমাদের চেতনার বিষয়বস্তু, কাজেই ঐ গুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই বাঞ্চনীয়।নীতিশাস্ত্র ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বিশ্লেষণের মাধ্যমে আরম্ভ হয়।এই পর্যায়ে নীতিশাস্ত্র ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।আমরা বাস্তব জীবনে কি কামনা করি তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে নীতিশাস্ত্র পরমকল্যাণের স্বরুপ নির্ধারণ করে।চিন্তাবিদ মিল সুখকেই জীবনের পরমকল্যাণ বলে মনে করেন।তঁার মতে,সুখই কল্যাণ, কেননা বাস্তব জীবনে আমরা সুখের সন্ধান করি এবং দুঃখ পরিহার করতে চাই।মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি আচরণের স্বরুপ বিশ্লেষণ করে,আচরণের ঔচিত্য সম্পর্কে আলোচনা করে না।এই পদ্ধতি নৈতিক ঘটনার বিষয়নিষ্ঠ আলোচনা করে। সমালোচনাঃমনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়।এই পদ্ধতি বিষয়নিষ্ঠ ও আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানের কোনো পার্থক্য নির্দেশ করতে পারে না।বিষয়নিষ্ঠ বিজ্ঞান বস্তু বা ঘটনার স্বরুপ সম্পর্কে আলোচনা করে,আর আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান ঘটনার ঔচিত্য-অনৌচিত্য সম্পর্ক আলোচনা করে।আদর্শকে বাস্তবের আলোকে বিচার করা যায় না।আমাদের আচরণ কি,মনস্তাত্ত্বিক আচরণের স্বরুপ বর্ননা করে এবং আচরণকে তার উপাদান সমূহে বিশ্লেষণ করে;কিন্তু নৈতিক আদর্শের আলোকে আমাদের আচরণের যথার্থ বিচার করতে পারে না।নীতিশাস্ত্র আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান।মনোবিজ্ঞানের বিষয়নিষ্ঠ পদ্ধতি নৈতিক আদর্শের ব্যাখ্যা করতে পারে না।এই পদ্ধতি আমাদের আচরণের ভিত্তি নির্দেশ করে;কিন্তু আচরনের ভাল বা মন্দ বিচার করতে পারে না।
(২)বিবর্তনমূলক পদ্ধতি (genetic method):হার্বার্ট স্পেন্সার(Herbert Spencer),লেসলি স্টিফেন(Leslie Stephen)ও অন্যান্য বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদের মতে,আমাদের নৈতিক ধারণা,প্রতিষ্ঠান ও বিধি ধীরে ধীরে আদিম জাতির রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার থেকে উন্নত হয়েছে।নৈতিকতা সামাজিক বিবর্তনের পরিণতি।নৈতিক ধারণা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি ও ক্রম বিববর্তনের ধারা বর্ননাই নীতিশাস্ত্রের লক্ষ্য।কাজেই নীতিশাস্ত্রের স্বরুপ ও নীতিসমূহের জ্ঞান লাভ করতে হলে ঐতিহাসিক বা বিববর্তনমূলক পদ্দতির সাহায্য গ্রহন করতে হবে। সমালোচনাঃবিবর্তনমূলক পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের আসল স্বরুপ উদঘাটন করতে পারেনা।আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে নীতিশাস্ত্রের লক্ষ্য হলো,আচরণের ভালো বা মন্দ,ঔচিত্য -অনৌচিত্য বিচার করা,মানুষের আচরনের বিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যা করা নয়।মানুষের নৈতিক আচরণ ও প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নীতিশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় নয়।নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে মানুষের আচরণের যথার্থ বিচার করাই নীতিশাস্ত্র এর কাজ।কাজেই বিবর্তন মূলক পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের উপযোগী পদ্ধতি নয়।
(৩)পরাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (metaphysical method):হেগেল(Hegel),গ্রিন(Green) ও তঁাদের অনুসারীদের মতে,পরমসত্তার প্রকৃতি থেকে মানুষের নৈতিক আদর্শকে অনুমান করা যায়।নীতিশাস্ত্র বিজ্ঞান হলেও সময় সময় বিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে পরাবিজ্ঞানের স্তরে উন্নিত হয়।নৈতিক অাদর্শ ভুয়োদর্শন এর ফল নয়-পরম সত্তার ই বহিঃপ্রকাশ। পরমসত্তা প্রকৃতি ও সসীম মনের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে থাকে।মানুষের মন পরমসত্তা প্রকাশিত নৈতিক আদর্শকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হয়।মানুষের নৈতিক অাদর্শ খোদার পূর্ণতারই প্রকাশ।নীতিশাস্ত্র পরাবিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে,নীতিশাস্ত্রের পদ্ধতি পরাবৈজ্ঞানিক। সমালোচনা: নীতিশাস্ত্র যে একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান,এই পদ্ধতি তা প্রদর্শন করতে পারে না।এটি নীতিশাস্ত্র কে পরাবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করে।নীতিশাস্ত্র পরাবিজ্ঞানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত,কিন্তু পরাবিজ্ঞানের শাখা নয়।পরাবিজ্ঞান বরং নীতিশাস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেননা পরাবিজ্ঞান বাস্তব ও আদর্শ উভয়কে একটি নিয়ম শৃৃঙখলার অধীনে আনয়ন করে।সুতরাং পরাবিজ্ঞানের পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের পদ্ধতি বলে বিবেচিত হতে পারে না।

0/Post a Comment/Comments