সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন
আমরা সকল শিশুর শিক্ষার কথা বলছি। এখনও অনেক শিশু আছে, যারা শিক্ষার সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এদের মধ্যে দরিদ্র, বস্তিবাসী, উপজাতি, বেদে প্রভৃতি পরিবারের শিশুসহ পথশিশু, এতিম, পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত, প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডার ও যৌনকর্মীদের শিশু অন্যতম। এইসব শিশুকে মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা আনতে পেরেছি কি না। মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় আনতে পারলেও তাদের চাহিদা অনুযায়ী পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে কি না। এই শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারলেই আমরা সকল শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার কথাটি দৃঢ়ভাবেই বলতে পারব।
সকল শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার অর্থেই সরকার প্রতিটি বিদ্যালয়ে একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষককে একীভূত শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। একীভূত শিক্ষা চালুর বিষয়ে চারটি প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, সংবিধান অনুযায়ী কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। একীভূত শিক্ষা চালু হলে শিশুর প্রতি বৈষম্য থাকবে না। দ্বিতীয়ত, সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংক্রান্ত সম্মেলন যেমন থাইল্যান্ডের জমতিয়েন সম্মেলন ১৯৯০, সেনেগালের ডাকার ঘোষণা ২০০০, জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯-এ অংশগ্রহণ ও ঘোষণার স্বাক্ষর প্রদান এবং সকল নাগরিকের মানসম্মত মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। তৃতীয়ত, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে সকল শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। চতুর্থত, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে সাম্যভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সুতরা ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে একীভূত শিক্ষার বিকল্প নাই।
একীভূত শিক্ষা কার্যক্রমে মূলত চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হলো—১. জেন্ডার-ট্রান্সজেন্ডার তথা মেয়েশিশু, ২. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশু, ৩. ঝুঁকিগ্রস্ত শিশু ও ৪. প্রতিবন্ধী শিশু। জেন্ডার-ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে নারী, পুরুষ ও হিজড়াদের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় পুরুষের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়, নারীর অংশগ্রহণ কম ও হিজড়াদের সমাজে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নাই। মূলত নারী, পুরুষ ও হিজড়াদের এই বৈষম্য বিরাজ করলে একটি সমাজ এগুতে পারে না। একটি দেশের উন্নয়নে সকল ধরনের নাগরিকের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এই চিরায়ত বৈষম্য দূর করতে প্রথমেই আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে দৃষ্টিভঙ্গিতে। সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে। সমতা ও সাম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষের সমমর্যাদাসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই পরিবর্তন আনার জন্য বিদ্যালয়ে মেয়েশিশু ও হিজড়াশিশুদের ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যালয় গমনে তাদের বাধাসমূহ চিহ্নিত করাসহ তা অপসারণ করতে হবে। শিক্ষকরা মেয়েশিশু ও ছেলেশিশুর ভূমিকাকে সমানভাবে কাজে লাগাবেন।
আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যারা আছে, তাদের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্যের কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে বিভিন্ন বাধা তৈরি হয়। এই বাধাসমূহ দূর করার জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে প্রথম কাজটি করেছে তাদের নিজস্ব ভাষায় প্রাক প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা। চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা ও সাদরী (ওরাও) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের পাঠ্যপুস্তক হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে। দোভাষী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রত্যেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর ব্যবস্থা রেখে শিক্ষকরা পাঠ পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন।
‘সবার জন্য শিক্ষা আন্দোলন’ একটি বৈশ্বিক ও সাংবিধানিক অধিকার। একীভূত শিক্ষাকে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পারলে সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়ন আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
Post a Comment