গবেষণার নকশা
সমাজ সদা পরিবর্তনশীল ও বিবর্তনশীল। তাই গবেষণার ধাপ ও নকশাও পরিবর্তনশীল। সাধারণত কোন গবেষণা কর্মের সফলতার জন্য কতকগুলো ধাপ বা পর্যায়ক্রম অতিক্রম করতে হয়, যা গবেষণা নকশা হিসাবে পরিচিত।
Georg J. Mouly, P.V. Young, Roy. G. Francis, Kenneth D. Bailey. Norman A. Polansky. T.S. Wilkinson, Hans Raj, Goode & hatt, প্রমুখ সামাজিক গবেষকের মতামত অনুসারে নিন্মলিখিত ধাপ বা স্তরগুলর কথা বলা হয়েছে-
১. গবেষণা সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও নির্বাচন ;২. প্রচালিত জ্ঞানের সাথে পরিচিতি
৩. অনুমান বা প্রকল্প গঠন; ৪. কার্যকারী সংজ্ঞা প্রদান; ৫. তথ্য সংগ্রহের উৎস খোঁজা ; ৬. তথ্য সংগ্রহ
৭. তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষণ ৮. ফলাফল উপস্থাপন
নিন্মোক্ত চিত্রের সাহায্যে গবেষণা নকশাকে প্রকাশ করা যায়-
স্তরগুলোর ব্যাখ্যা- নিন্মোক্ত ভাবে স্তরগুলোর ব্যাখা প্রদান করা হল-
১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ বা নির্বাচন- আসলে একটি গবেষণা শুরু হয় একটি সমস্যা দিয়ে। এ সমস্যার একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে এটিকে সমাধানযোগ্য হতে হবে। এছাড়া বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানের আওতাধিন যে কোন বিষয়ের সঙ্গেই সমস্যাটি সংশ্লিষ্ট হতে হবে। এই সমস্যা নির্বাচনে গবেষককে নিন্মেলিখিত বিষয়াবলীর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন-
ক. গবেষণার বিষয়বস্তুকে প্রশ্নাকারে এমন ভাবে সাজাতে হবে যাতে সুনির্দষ্ট উত্তর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
খ. পর্যাপ্তভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত করার উপযোগী করে বিষয়বস্তুকে সীমাবদ্ধ করা।
গ. তাত্ত্বিক বা প্রয়োগিক দিক থেকে সমস্যাটির তাৎপর্য আছে কিনা তা যাচাই করা।
ঘ. গবেষণা পরিচালনা ও তথ্য সংগ্রহের সুযোগ ও উপকরণ পর্যাপ্ত কিনা তা যাচাই করা।
ঙ. গবেষণার জন্য সময় ও অর্থ যোগান সম্ভব কিনা তা যাচাই করা।
চ. গবেষণার নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা।
২. সাহিত্য পর্যালোচনা- নির্বাচিত গবেষণা ও সমস্যার প্রাসাঙ্গিক বিভিন্ন রচনা, লেখা, বই-পুস্তক, গবেষণা, রিপোর্ট ইত্যাদি খুঁজে বের করে তার সাথে পরিচিত হতে হয় এক্ষেত্রে ৪”
৬” অথবা ৫”
৮” কার্ডে প্রয়োজনীয় নোট রাখতে হয়। এতে করে পরস্পর সম্পর্কিত তথ্য একই সঙ্গে রাখতে, নির্ধারিত প্রশ্নাবলীকে তীক্ষ্ণতর করতে এবং অসম্পূর্ণতা পূরণ সহজ হয়। সাহিত্য পর্যালোচনার সুবিধাসমূহ-


ক. গবেষণা কর্মের পুন্রাবৃত্তি রোধে সাহায্য করে। খ. সময় ও শ্রম বাঁচায়।
গ. অর্থের সাশ্রয় হয়। ঘ. গবেষণা কোন স্থান থেকে শুরু করতে হবে, সে সম্পর্কে ধারনা করা সম্ভব।
ঙ. নতুন তথ্য সংযোজনে সহায়তা করে।
৩. অনুমান বা প্রকল্প গঠন- অনুমান বা প্রকল্প গবেষকের জন্য কোন সমস্যার প্রস্তাবিত বা ধারনাকৃত সমাধান। গবেষণা কর্মের শুরুতে ই বিষয় সম্পর্কে সাধারন একটি ধারনা করে নেওয়া হয়। যার উপর ভিত্তি করে এর পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বস্তুত প্রকল্প হচ্ছে একটি পরীক্ষণীয় উক্তি যা সম্ভবত সমস্যার একটি সমাধান। যেমন- “অধিক শিশুমৃত্যুধারী দম্পতি জম্ননিয়ন্ত্রন পদ্ধতি কম ব্যবহার করবে” এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হতে পারে। প্রকল্পের সুবিধাবলী-
ক. গবেষণা নির্দিষ্ট দিকে অগ্রসর হয়।
খ. গবেষণার ধরন সম্পর্কে পূর্ব হতে জানা যায়।
গ. তথ্য সংগ্রহের উৎস ও পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা নেওয়া যায়।
ঘ. গবেষকের শ্রম, সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়।
৪. কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান- যে কোন গবেষণাতেই গবেষক কিছু চল বা বিশেষ অর্থবোধক শব্দ বা পদ ব্যবহার করে থাকেন। তাই এ পর্যায়ে ঐ চল বা বিশেষ অর্থবোধক পদ/শব্দের কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ এ পর্যায়ে গবেষণার ব্যবহৃত পদ বা শব্দকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এর সুবিধাসমূহ-
ক. ব্যবহৃত শব্দে/চলের অর্থের বিভিন্নতা সৃষ্টি হবে না।
খ. গবেষকের অর্থের ব্যবহারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না।
গ. গবেষকের শব্দ বা চল ব্যবহারের উদ্দ্যেশ্য ব্যাহত হবে না।
৫. উৎস নির্বাচন- গবেষণা সমস্যা, প্রকল্প উদ্দেশ্য ও চলকের ধরন বা প্রকৃতি বিবেচনা করে কোন কোন উৎস হতে কিভাবে, কাদের কাছ থেকে কোন জাতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এতে করে গবেষক তার তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, স্তর, অঞ্চল, ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ছক পেয়ে যাবেন, যা তার কাজের গতিকে অনেক ত্বরান্বিত গতিশীল এবং সাশ্রয়ী করতে সহায়তা করবে।
৬. তথ্য সংগ্রহ- তথ্যের উৎস, স্থান, ধরন ইত্যাদি যাচাই ও বিবেচনা করে গবেষক বিভিন্ন সুবিধাজনক পদ্ধতিতে (যেমন- প্রশ্নমালা, সাক্ষাৎকার, জরিপ ইত্যাদি) গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করবেন। তথ্য সংগ্রহ গবেষণা কর্মের প্রধানতম অধ্যায়। কেননা ইহা সংগ্রহের যথার্থতা, পারদর্শিতা, ও নির্ভুলতার উপরেই গবেষণা কর্মের সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে। তাই এই স্তরে অধিক সতর্ক ও মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৭. তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণ- তথ্য গবেষণার মূল উপাদান হলেও বস্তুত তথ্য গবেষণা একমাত্র উপাদান নয়। তথ্যের বস্তুনিষ্ঠ, সুশৃঙ্খল, সংখ্যাতাত্ত্বিক বর্ণনা দান, কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণ এবং অনুমান বা প্রকল্প যাচাই বা তত্ত্ব গঠনের উদ্দেশ্য তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে মূলত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
৮. ফলাফল উপস্থাপন- Goode & Hatt – এর মতে, গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে গবেষণা ফলাফল আগ্রহী ব্যক্তিদের নিকট পৌঁছানো এবং প্রকাশ করা। যাতে পাঠক তথ্যগুলো বুঝতে পারে ও নিজেই গবেষণার ফলাফলের যথার্থতা নিরূপণ করতে পারেন। সর্বশেষে এ পর্যায়ে তাই বিশ্লেষিত তথ্যের ফলাফল ও প্রাসাঙ্গিক সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।
উপসংহার- উপরিউক্ত স্তরগুলোর সবগুলো পদ্ধতিই যে হুবহু অনুসরণ করতে হবে, এমনটি নয়। এক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন গবেষক তার সুবিধা ও গবেষণার ধরন অনুযায়ী করতে পারেন। তবে কয়েকটি অপরিহার্য স্তরকে (যেমন- সমস্যা নির্বাচন, প্রকল্প প্রণয়ন, তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, ফলাফল উপস্থাপন) অবশ্যই অতিক্রম করতে হয়।
Post a Comment