ডিপ্রেশন : অজানা রোগ যখন মনের গভীরে - আশরাফুল আলম আশিক

কোনো কোনো আঘাত আমাদের শক্ত করে তোলে, ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জোগায়। কিন্তু এমন কিছু আঘাত আছে যা আমাদের একদম বিধ্বস্ত করে দেয়। আর সেটা এমনকি আত্মহত্যায় গড়ায়। কারোর কারোর এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে মৃত্যু ছাড়া সে অন্য কিছুতে শান্তির কথা চিন্তাই করে না। আর সেই অবস্থার নামই হলো বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন।

কিছুদিন আগে এক ব্লগে ডিপ্রেসড এক কিশোরের বক্তৃতা শুনেছিলাম—যেখানে সে বলেছিল, “ডিপ্রেশন এমন এক রুমমেট, যাকে আপনি লাথি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিতে পারবেন না আবার সাথে নিয়েও থাকতে পারবেন না।”

ডিপ্রেশন আসলে অদ্ভুত এক ধরনের ইমোশনাল ইলনেস এবং এ রোগে ব্যক্তির মন-মেজাজ বা মুডের দিন দিন অবনতি ঘটে দারুণভাবে। এ রোগটি প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভেঙে পড়েন, অলস হয়ে যান, হয়ে যান অকর্মঠ, নিস্তেজ, শক্তিহীন ও মানসিক ভারসাম্যহীন।

জানা যায় আমেরিকায় প্রতি ২০ জনে একজন মারাত্মক ধরনের ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তাদের জীবনে কখনো না কখনো ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন।

ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা আসলে কী?

এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। ডিপ্রেশন খুবই কমন কিন্তু মারাত্মক এক ধরনের মানসিক ব্যাধি যা আপনার অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা অনেক সময় দুঃখবোধ ও বিষণ্নতাকে এক বলে মনে করি। এ দুটো কিন্তু এক নয়। দুঃখবোধ হলো সাময়িক মন খারাপ যা অল্প কিছু সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়। এর জন্য কোনো চিকিত্সার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, ডিপ্রেশন দীর্ঘকালীন সমস্যা। যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপযুক্ত চিকিত্সার ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

ডিপ্রেশন কিংবা বিষণ্নতার বিপরীত কখনোই আনন্দ নয়, বরং সক্ষমতা। কথাটা হয়ত একটু জটিল শোনাচ্ছে তাহলে আরেকটু ভেঙে বলি—আপনি তো ডিপ্রেসড নন, তার মানে এই নয় যে, আপনি সারাদিনই খুব ফূর্তিতে আছেন, আনন্দে আছেন। বরং আপনি ডিপ্রেসড নন, তার মানে হচ্ছে আপনি স্বাভাবিক বা চিন্তামুক্তভাবে জীবন যাপন করছেন।

ধরুন, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠছেন, বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যাচ্ছেন। সেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন, বসের সঙ্গে মিটিং করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। তারপর আবার দিনশেষে বাসায় এসে স্বামী কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছেন, ঘুরছেন ইত্যাদি। ডিপ্রেশন আপনার এই দৈনন্দিন সক্ষমতাকে শেষ করে দেয়। আপনাকে আপনার দৈনন্দিন কাজ-কর্ম থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তাদের শরীর থাকে সুস্থ, কিন্তু তারা মনের বিরুদ্ধে ঘরের বাইরে বের হতে পারেন না। তারা তাদের শরীরকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অফিসে নিয়ে যান, মিটিং করেন, সবার সঙ্গে কথা বলেন ইত্যাদি। তারপর একদিন আর এসবও পারেন না। আশেপাশের মানুষের সঙ্গেও কথা বলেন না। চুপচাপ ঘরবন্দি হয়ে পড়েন। তখন আমরা তাকে অসামাজিক খেতাব দেই।

আমরা সাধারণত আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই সব বিচার করতে চাই। আমরা বুঝতে চাই না যে আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরেও আরো জটিল অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। প্রতিটি মানুষের সংগ্রামই তার নিজস্ব, আত্মকেন্দ্রিক বা তার জন্য ইউনিক। প্রত্যেকের চিন্তায় কিন্তু খেয়েপরে বেঁচে থাকার স্ট্রাগলই তার একমাত্র স্ট্রাগল নয়। হয়ত তার পরিবার কিংবা কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাকে অসুখী করে তুলেছে। কিংবা সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধু মস্তিষ্কের রাসায়নিক সামঞ্জস্যের অভাবে সে অসুখী। যে কোনো কারণে একজন মানুষ ডিপ্রেসড হতে পারে আর তার কষ্টটুকুও কিন্তু মেকি নয়!

কেন হয় ডিপ্রেশন?

ডিপ্রেশন একটি জটিল রোগ। কেন এ রোগ হয় নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব নয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই কিছু সাধারণ কারণ থাকে যার জন্য এ রোগের উত্পত্তি হতে পারে। আবার দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ সেবনের ফলেও কেউ কেউ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন কারণে মানুষ বিষণ্নতায় ভুগে থাকে। ব্যক্তিভেদে বিষণ্নতার কারণে পার্থক্য দেখা যায়। ডিপ্রেশনের অন্যতম লক্ষণ হলো অনিদ্রা।

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির একদম নির্দিষ্ট সঠিক উপায় নেই। তবে কিছু উপায় আছে। আর এটা হলো নিজের সঙ্গে যুদ্ধ। রুটিনমাফিক চলা, লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা, সঠিক সময়ে খাওয়া, অনিদ্রা দূর করা, ব্যায়াম করা, সর্বদা ইতিবাচক চিন্তা করা, আনন্দে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি নিয়মিত নিজে নিজে করতে পারলে অবশ্যই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে কিছু কিছু পর্যায়ে এ রোগের চিকিত্সাও সম্ভব। এ ছাড়া মেডিটেশন কিংবা কাউন্সেলিং-এর সাহায্যেও ডিপ্রেশন মুক্ত হওয়া সম্ভব। তবে আশার কথা যে, ডিপ্রেশনের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিত্সাও কিন্তু রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাতারাতি বিষণ্নতামুক্ত হওয়া কখনোই সম্ভব নয় বরং এ জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। মনোরোগ চিকিত্সককে সময় দিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ঊনবিংশ শতাব্দী বিশ্বের জন্য রেনেসাঁসের শতাব্দী হয়ে থাকে, তবে আমি বলব একবিংশ শতাব্দীকে উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, ভয়, বিকারের শতাব্দী! একবিংশ শতাব্দী নিয়ে এসেছে বিরাট অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক ব্রেক এবং বিশ্বব্যাপী নানা সংকট। আমরা যত সৃষ্টিমূলক কাজে নিয়োজিত থাকব, ততই টেনশনমুক্ত থাকা যাবে।

লেখক :গবেষক
দৈনিক ইত্তেফাক - ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭

0/Post a Comment/Comments