মো. আহসানুল আরেফিন চৌধুরী
সহকারি অধ্যাপক
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পাবনা।
ভূমিকা
শিক্ষা ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (Information and Communication Technology - ICT) সফলভাবে প্রয়োগের একটি কার্যকর কৌশল হলো শ্রেণি কার্যক্রমে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ (Digital Learning Resource) ব্যবহার করা। শিক্ষার বিষয়বস্তুকে আকর্ষণীয় করে শিক্ষার্থীর কাছে উপস্থাপনের জন্য ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ এখন বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি UNESCO –র একটি রিপর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ-এর ব্যবহার বিভিন্ন দেশে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে সরকার ২০০৯ সালে ঘোষিত জাতিয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালাতে মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক বিষয়বস্তু উন্নয়ন ও তা শ্রেণি কার্যক্রমে ব্যবহার করার জন্য সুপারিশ করেছে। তারই ধারাবাহিকতায়, জাতিয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষাদানের উপকরণ হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার স্কুলগুলোতে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম সরবরাহ করা শুরু করেছে এবং শিক্ষকগণকে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করতে সক্ষম করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের সকল শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকগণের ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক।
শিখনফল
এই পাঠ শেষে আপনি-
1. ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ –এর ধারণা উদাহারণসহ ব্যাখ্যা করতে পারবেন
2. শ্রেণি কার্যক্রমে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের উপযোগিতা বর্ণনা করতে পারবেন
3. কার্যকর ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের বৈশিষ্ট্য বলতে পারবেন
4. ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুতি ও সংগ্রহের মাধ্যম উল্লেখ করতে পারবেন
ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ-এর ধারণা
সহজ কথায় বলতে গেলে, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিখন সহায়ক যেসকল উপকরণ প্রস্তুত করা হয় তাকে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ বলে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত যে কোন প্রকারের তথ্যের উৎপত্তি, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চালন ও বিস্তরনের উপযোগি সকল ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিই ডিজিটাল প্রযুক্তি; যেমনঃ কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। এইসব ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাবহার করে বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করা যায় যা গতানুগতিকভাবে শ্রেণিকক্ষে ব্যবহৃত উপকরণের চেয়ে অধিক কার্যকর। নিচের উদাহারণে গতানুগতিক ও ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার প্রসঙ্গে দুইটি পরিস্থিতি বর্ণনা করা হলো; এই উদাহারণ থেকে ডিজিটাল উপকরণের ধারণা ও এর কার্যকারিতা অনুধাবন করা যায়।
পরিস্থিতি-১: গতানুগতিক শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে শ্রেণিতে পাঠদান | একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদেরকে ‘সৌরজগৎ’ বিষয়টি পাঠদান করার পরিকল্পনা করলেন। এইজন্য তিনি সৌরজগৎ-এর একটি বড় চিত্র/পোস্টার শ্রেণিতে ঝুলিয়ে দিলেন এবং সূর্য ও তার গ্রহগুলোক কক্ষপথ ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করলেন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো তিনি বোর্ডে লিখে দিলেন। শিক্ষার্থীরা সৌরজগৎ-এর একটি কাল্পনিক স্থির চিত্র দেখলো এবং প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে নিল। |
পরিস্থিতি-২: ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে শ্রেণিতে পাঠদান | অপর একজন শিক্ষক ‘সৌরজগৎ’ বিষয়টি পাঠদানের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করলেন। তিনি ইন্টারনেট থেকে সৌরজগৎ-এর প্রত্যেক গ্রহের একটি করে বাস্তব চিত্র ডাউনলোড করলেন। সেই সাথে YouTube থেকে সৌরজগৎ-এর গ্রহগুলোর পরিভ্রমণের একটি সুন্দর ভিডিও চিত্র ডাউনলোড করলেন। এরপর তিনি এইসব ছবি ও ভিডিও চিত্রকে পাওয়ারপয়েন্ট-এ যথাযথভাবে সাজিয়ে কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়ার সাহায্যে শ্রেণিতে উপস্থাপন করলেন। শিক্ষার্থীরা সৌরজগৎ-এর বিভিন্ন গ্রহের বাস্তব চিত্র দেখলো; সূর্য্যকে কেন্ত্র করে গ্রহগুলোর পরিভ্রমনের ভিডিও চিত্র দেখলো এবং প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে নিল। |
উপরোক্ত দুইটি পরিস্থিতির কোনটি অধিক কার্যকর? কোনটিতে শিক্ষার্থীরা অধিক আগ্রহ নিয়ে শিখবে? উদাহারণ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, পরিস্থিতি-২ এর শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম অধিক কার্যকর। দ্বিতীয় পরিস্থিতে উল্লেখিত শিখন সহায়ক উপকরণসমূহ (ছবি, ভিডিও) ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের কিছু উদাহারণ।
ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে; যেমন, একটি সাধারণ ডিজিটাল ফটোগ্রাফ/ছবি থেকে শুরু করে শব্দ, ছবি, ভিডিও, এনিমেশন ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত জটিল সফটওয়্যার পর্যন্ত সবকিছুই ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ হতে পারে, যদি তা শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়। নিচে শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের বিভিন্ন প্রকার ও ব্যবহারের কিছু উদাহারণ দেয়া হল।
বাংলা সাহিত্যের কোন কবিতা/গল্প/প্রবন্ধ পাঠদানের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক কবি/লেখকের ছবি, সৃষ্টিকর্ম ও অবদানের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে শ্রেণিতে ব্যবহার করতে পারেন। সেই সাথে নতুন ও কঠিন শব্দগুলো শেখানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ছবি/ভিডিও/এনিমেশন ইত্যাদি দেখানো যেতে পারে।
ইংরেজী ক্লাসে ব্যবহারের জন্য ReadPlease নামক একটি সফটয়্যার ইন্টারনেটে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এই সফটয়্যারটি ডাউনলোড করে ইনস্টল করা যেতে পারে। এই সফটয়্যারটিতে যেকোন ইংরেজী শব্দ বা একটি অনুচ্ছেদ লিখে দিলে তা উচ্চারন করে বা পড়ে শোনায়। এই সফটয়্যারটি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদেরকে ইংরেজী শব্দের সঠিক উচ্চারণ শোনা ও বলা রপ্ত করতে সাহায্য করা যায়।
সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু পাঠদানের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বা সমস্যার সংশ্লিষ্ট ছবি বা ভিডিও চিত্র ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদেরকে দেখিয়ে শ্রেণি কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত করতে পারেন। যেমন, ‘যৌতুক’ বিষয়ে পাঠদান করতে চাইলে যৌতুকের ধারণা, এর প্রকৃতি, ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেক ভিডিও ক্লিপ, ছবি, সংবাদ পত্রের রিপোর্ট ইত্যাদি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে শিক্ষার্থীদেরকে দেখিয়ে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান দান করা যেতে পারে।
বিজ্ঞান বিষয়ের অনেক জটিল ও দূর্বোদ্ধ বিষয়ের চমৎকার এনিমেশন/ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটে বিনামূল্যে পাওয়া যায়, যা বিজ্ঞান শিক্ষাকে সহজ ও আকর্ষণীয় করতে পারে। যেমন, পরমাণুর গঠন, সালোকসংশ্লেষণ, মানব দেহের পরিপাকতন্ত্র ইত্যাদির চমৎকার এনিমেশন YouTube থেকে সংগ্রহ করে শ্রেণি পাঠে ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীরা সহজে ও আগ্রহের সাথে শিখবে। অনুরুপভাবে, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি সকল বিষয়ের ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ইন্টারনেটে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন বিষয়ের ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহের কিছু ওয়েবসাইটের ঠিকানা এই পুস্তকের শেষে [পরিশিষ্ট-০১] দেয়া হয়েছে; শিক্ষকগণ এখান থেকে তাদের পছন্দমতো ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ডাউনলোড করে এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করে তাদের শ্রেণিতে ব্যবহার করতে পারবেন। আবার শিক্ষারথীরাও সেখান থেকে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে স্বশিখনে উদ্বুদ্ধ হতে পারবে।
ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ-এর উপযোগিতা
শিক্ষণীয় বিষয়কে সহজবোধ্য করে ও আকর্ষণীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করার জন্য শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এই উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়গুলোতে গতানুগতিকভাবে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে বোর্ড, পোস্টার, চার্ট, মডেল, চিত্র ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু দেখা যায়, এই ধরণের উপকরণগুলো সহজেই নষ্ট হয়ে যায় এবং কিছু দিন পরেই এগুলি সংস্কারের প্রয়োজন হয় অথবা নতুন করে কিনতে হয়। অথচ বিদ্যলয়গুলোতে পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় নিয়মিত এই ধরণের শিক্ষা উপকরণ কেনা সম্ভব হয় না, ফলে অধকাংশ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষা উপকরণ অপ্রতুল। আবার অনেক ক্ষেত্রেই শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশী হয় যে পেছনের বেঞ্চে বসা শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে শিক্ষা উপকরণ দেখতেও পায় না। এছাড়াও গতানুগতিকভাবে ব্যবহৃত শিক্ষা উপকরণগুলোর অধিকাংশই দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তাকর্ষক হয় না বলে শিক্ষার্থীরাও কম আগ্রহি হয়। গতানুগতিক শিক্ষা উপকরণের এই রকম নানা সমস্যার কারণে শিক্ষকগণও শ্রেণিতে তা ব্যবহারে তেমন উৎসাহিত হন না।
উপরোক্ত সমস্যাগুলোর বহুলাংশে সমধান দিতে পারে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ। ইন্টারনেট থেকে সহজেই এবং বিনামূল্যে অনেক ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করা যায়। বাজারেও স্বল্প মূল্যে CD/DVD-তে কিছু কিছু ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ কিনতে পাওয়া যায়। তাছাড়া, শিক্ষকগণ নিজেরাও তাদের প্রয়োজনমতো ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করতে পারেন। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সহজে নষ্ট হয় না এবং বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যায়। একজন শিক্ষক একবার তার প্রয়োজনীয় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ বা প্রস্তুত করে নিলে তা বারবার ব্যবহার করতে পারবেন, এবং অন্যান্য শিক্ষকের সাথে শেয়ার/বিনিময় করতে পারবেন। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তাকর্ষক হয় বলে শিক্ষার্থীরাও শিখতে মনোযোগি ও আগ্রহি হয়। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সাহায্যে বড় করে দেখানো যায় বলে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর শ্রেণিতেও সকলেই তা দেখতে পারে, শুনতে পারে এবং বুঝতে পারে।
কার্যকর ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের বৈশিষ্ট্য
শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ডিজিটাল সামগ্রী ব্যবহার করতে হলে তার কতগুলো শিক্ষামূলক বৈশিষ্ট্য থাকেতে হবে, যেমনঃ
১। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ অবশ্যই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে;
২। শ্রেণীতে যে বিষয়ের পাঠদান কার্যক্রমে ব্যবহার করা হবে, ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সেই পাঠের এক বা একাধিক শিখনফল অর্জনে সহায়ক হবে;
৩। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে উপস্থাপিত তথ্য বা জ্ঞান সঠিক হতে হবে; কোন ভুল তথ্য বা ধারণা দেয়া যাবে না।;
৪। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণে ব্যবহৃত ছবি, ভিডিও, এনিমেশন, উদাহারণ ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের পরিচিত সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে নেয়া উচিত। বিদেশী ছবি বা ভিডিও যা শিক্ষার্থীর সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা দেখানো উচিত নয়, কারণ এতে শিক্ষার্থীদের মনে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হতে পারে;
৫। কোন জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, রাজনৈতিক আদর্শ, দেশ, অঞ্চল, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে হেয় করে বা আঘাত করে -এমন কোন ছবি, ভিডিও, শব্দ, বাক্য বা উদাহারণ ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণে ব্যবহার করা যাবেনা;
৬। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তাকর্ষক হবে যেন শিক্ষার্থীরা শিখতে উৎসাহিত হয় এবং আগ্রহ নিয়ে শিখে;
৭। একটি কার্যকর ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ শুধু তথ্য বা জ্ঞান সরবরাহ করবে না, বরং শিক্ষার্থীর চিন্তনকে উদ্দীপ্ত করে নতুন বিষয় শিখতে আগ্রহি করবে। উদাহারণস্বরুপ বলা যেতে পারে, ‘সড়ক দূর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার’ সরাসরি শিক্ষার্থীদের না বলে একজন শিক্ষক ইন্টারনেট থেকে কিছু সড়ক দূর্ঘটনার ভিডিও চিত্র ডাউনলোড করে শ্রেণিতে দেখিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, “যে সড়ক দূর্ঘটনাটি দেখলে, কী কারণে এটি ঘটলো?” এবং “কী করলে এই দূর্ঘটনাটি এড়ানো যেত?” এই ধরণের ভিডিও চিত্র বা ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে উৎসাহিত করে;
৮। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ এমন হবে যেন তা সহজে ব্যবহার করা যায় এবং এটি ব্যবহার করার জন্য কোন বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন না হয়। অর্থাৎ যার কম্পিউটার চালনার মৌলিক দক্ষতা আছে, সেই যেন খুব সহজেই ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে পারে;
9। পাঠদানের কাজে ছাড়াও ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়ন, ফলাবর্তন (Feedback) ও শিখন অনুশিলনের কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে;
১০। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য পরিহার করতে হবে;
১১। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের, যেমন- অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু, শিখন সহায়ক ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুতি ও ব্যবহারে জোর দিতে হবে;
১২। ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণে ব্যবহৃত ছবি, ভিডিও, শব্দ, বাক্য/লেখা ইত্যাদি হতে হবে পরিস্কার, স্পষ্ট ও আকারে বড় যেন পেছনের বেঞ্চে বসা শিক্ষার্থীরাও ভালোভাবে দেখতে ও বুঝতে পারে;
১৩। শিখনের বিভিন্ন সূত্রগুলোর যথাযথ প্রতিফলন থাকতে হবে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণে; অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা কিভাবে শেখে সে বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদগণ বিভিন্ন তত্ত্ব/সূত্র দিয়েছেন। সেই তত্ত্ব/সূত্রগুলোর প্রয়োগ ঘটিয়ে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করতে হবে।
ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত ও সংগ্রহ করা
পাঠের উদ্দেশ্য ও শিখনফল অর্জনে সহায়ক যেকোন ডিজিটাল সামগ্রীকে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ বলা যেতে পারে। এটা একটি সাধারণ ডিজিটাল ছবি থেকে শুরু করে জটিল মাল্টিমিডিয় সফটয়্যার, ভিডিও চিত্র, এনিমেশন ইত্যাদি হতে পারে। একজন শিক্ষক একটি ডিজিটাল ক্যামেরা বা তার মোবাইল ফোনের সাহায্য গৃহিত কোন ছবি/ভিডিও, যা পাঠের বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক, ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। আবার আগ্রহী শিক্ষকগন বিশেষ কিছু এপ্লিকেশন সফটয়ার, যেমনঃ পওয়ারপয়েন্ট, ফটোশপ, ফ্লাশ, মুভি মেকার ইত্যাদি শিখে নিয়ে নিজেদের প্রয়োজনমতো ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করতে পারেন। পেশাদার কম্পিউটার প্রোগ্রামারগণের সাহায্য নিয়েও শিক্ষকগণ ভাল মানের ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ তৈরি করতে পারেন।
শিক্ষকগণ নিজেরা ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করতে না পারলেও তারা ইন্টারনেট থেকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ/ডাউনলোড করে নিতে পারেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তা পাঠের শিখনফল অর্জনে সহায়ক হয়, শিক্ষার্থীর বয়সের উপযোগী হয় এবং সামাজিক প্রাক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ইন্টারনেটে অসংখ্য উৎস থেকে ছবি, ভিডিও এবং বিষয় ভিত্তিক ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করা যায়, যেমনঃ ভিডিও-র জন্য YouTube (www.youtube.com), ছবির জন্য Google Image (www.google.com), তথ্যের জন্য Wikipedia (www.wikipedia.org), BanglaPedia (www.bangladedia org) ইত্যাদি। এই পুস্তকের শেষে [পরিশিষ্ট-১] কিছু ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেয়া হয়েছে, যেখান থেকে আগ্রহী শিক্ষকগণ প্রয়োজনমতো ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করেতে পারবেন।
বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমের আলোকে এবং বাংলাদেশের শিক্ষকগণ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে সংগ্রহের একটি বড় উৎস হলো ‘শিক্ষক বাতায়ন’ (www.teachers.gov.bd)। শিক্ষক বাতায়ন-এ বিভিন্ন শ্রেণিভিত্তিক, বিষয়ভিত্তিক, এমনকি অধ্যয়ভিত্তিক ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সংরক্ষণ করা আছে। এই ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণগুলি প্রস্তুত করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকগণ। যে কেঊ শিক্ষক বাতায়ন থেকে তার প্রয়োজনমতো ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ডাঊনলোড করতে পারেন, আবার নিজের তৈরি ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ আপলোড বা সংরক্ষণ করতে পারেন যেন অন্যরা তা ব্যবহার করতে পারেন।
উপসংহার
শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের একটি কার্যকর হাতিয়ার। গতানুগতিক শিক্ষা উপকরণের তুলনায় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের বহুমুখী সুবিধা বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও তাই শিক্ষায় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সরবরাহ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখে না, মূল ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকগণ। তাই শিক্ষকগণকে সর্বাগ্রে প্রস্তুত করতে হবে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে। এই জন্য শিক্ষকগণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সেইসাথে শিক্ষকগণেরও সদিচ্ছা ও স্বশিখনে উদ্যোগি হতে হবে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য।
তথ্য নির্দেশিকা
১। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (২০০৯), জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯,বাংলাদেশ।
২। শিক্ষা মন্ত্রণালয় (২০১০), জাতিয় শিক্ষানীতি-২০১০, বাংলাদেশ।
৩। British Educational Communications and Technology Agency [BECTA],(2008). Choosing and Using Digital Learning Resources: A Guide for School Leaders, United Kingdom.
4। British Educational Communications and Technology Agency [BECTA], (2007). Quality Principles For Digital Learning Resources, United Kingdom.
৫। UNESCO (2010), ICT in Teacher Education: Policy, Open Educational Resources and Partnership, UNESCO Moscow Office.
Post a Comment