- মারুফা মিতু
নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সমতা, তবে কি সেটা শুধু কাগজে-কলমের বিষয়?
বাংলাদেশে নারী সমতার বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সুখকর! জরিপ বা তথ্য-উপাত্তে রয়েছে তারই ইঙ্গিত। নারী শুধু পেশাগত কাজেই নয়, আসীন রাজনীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও। কিন্তু শতকরা হিসাবে সেটি পুরুষের তুলনায় কত ভাগ?একই কাজ করে নারী পুরুষের সমান মজুরি পায় কি না—সে প্রশ্ন এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে নারীর মানবাধিকার, লিঙ্গবৈষম্য, আইনিব্যবস্থা, ভূমি মালিকানা এবং তাদের কর্মপরিবেশ নিয়ে।
জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ‘বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’ প্রকাশ করে। তাতে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে করা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম।
এর আগে ২০১৪ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৬৮ নম্বরে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দুই ধাপ কমেছে। এ ছাড়া জরিপ অনুযায়ী লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনা বা নারী-পুরুষের অসমতা দূর করার কাজে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবার থেকে এগিয়ে। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়ন—এই চার মাপকাঠির ভিত্তিতে এই সূচক প্রকাশ করা হয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে টানা ৯ বছর লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে বাংলাদেশ। এই যেমন ২০০৭ সালে বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে ১০০তম, ২০০৮ সালে ১৩০টি দেশের মধ্যে ৯০তম, ২০০৯ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে ৯৩তম, ২০১০ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে ৮২তম, ২০১১ সালে ১৩৫টি দেশের মধ্যে ৬৯তম, ২০১২ সালে ১৩৫টি দেশের মধ্যে ৮৬তম, ২০১৩ সালে ১৩৬টি দেশের মধ্যে ৭৫তম, ২০১৪ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে ৬৮তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। ২০১৪ সালের তুলনায় নারী দুই ধাপ এগিয়েছে শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঈর্ষণীয়। তবে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আগের থেকে পিছিয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নারীর অংশগ্রহণ দুই ধাপ পিছিয়ে।
অবশ্য এই অগ্রগতির হিসাবের মধ্যে একটি পরস্পরবিরোধিতা আছে, আর তা হলো—পিছিয়ে থাকা থেকে কতটুকু এগোলে অগ্রগতির হিসাব হয়, তা নিয়ে। কিন্তু একমাত্র পিছিয়ে থাকার চিত্রটি বুঝতে পারলেই প্রকৃত অগ্রগতি অনুধাবন করা যায়। তাই জরিপে বলা হয়, অগ্রগতির এই হার অব্যাহত থাকলে নারী-পুরুষের সমতা আসতে ১১৮ বছর লাগবে।
নারী কি পেয়েছে সমতা?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের পাঁচ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী। আর দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী।
১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মাত্র পাঁচজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে সংসদে ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া মন্ত্রিসভায় নারী আছেন—প্রধানমন্ত্রী নারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নারী, এমনকি জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। তবে নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি যে চারটি মাপকাঠিতে বিবেচনা করা হয়, তাতে বাংলাদেশের কেমন অবস্থান, সেটাই দেখার বিষয়।
জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে আট লাখ। তারা সবাই মজুরিবৈষম্যের শিকার। পুরুষের সমান কাজ করলেও মজুরি পায় কম। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামাঞ্চলে একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা গড়ে ১৮৪ টাকা পেলেও নারী শ্রমিকরা পায় মাত্র ১৭০ টাকা।
মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এই একটি তথ্যই যথেষ্ট। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ শতাংশের বেশি নারী তাঁদের পারিবারিক জীবনে কখনো না কখনো পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
এ ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে, এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার তিনটি। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে গড়ে মাত্র ৪ শতাংশ অপরাধী শাস্তি পায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম জানান, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও নানাবিধ কারণে দীর্ঘদিন এ দেশের নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার। এ বৈষম্যমূলক আচরণের মূলে পুরুষদের ওপর তাদের
অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। বর্তমানে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়েছে। নারীদের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অনেক এগিয়েছে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ও দীর্ঘদিন নারী প্রধানমন্ত্রী থাকার কারণে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। ’ বাংলাদেশের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিআরআইয়ের মতে, বিগত ছয় বছরের পরিসংখ্যানে নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তাদের দাবি, নারী উন্নয়নে গত ছয় বছরে বাংলাদেশ ২৫ ধাপ এগিয়েছে।
আয়শা খানম আরো বলেন, ‘পেশা, মজুরি এবং নিজের ঘরে নারী অসাম্যের শিকার। এটা দূর করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হয় সবার আগে। নারীরা আগের চেয়ে এগিয়েছে, সমতার বিচারের অসাম্য দূর হচ্ছে, কিন্তু তাতে অসাম্য দূর হয়নি। সমতা প্রতিষ্ঠা এখনো অনেক দূর। দেশের প্রচলিত আইন ও দৃষ্টিভঙ্গি নারীর সমতার পথে প্রধান বাধা। প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী হলেই নারীর সমতা বা ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয় না। আগে নিশ্চিত করতে হবে, তাঁরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার যাঁরা নিয়ন্ত্রক, তাঁরা পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁরা একটি সিস্টেমের প্রতিনিধিত্ব করেন আর সেই সিস্টেমটাই পুরুষতান্ত্রিক। তাই কোনো নারীর একক ক্ষমতায়ন নারীর ক্ষমতায়ন বা সমতা নিশ্চিত করে না। ’
এসব উপলক্ষ যে লিঙ্গবৈষম্যহীন দেশ গড়ে তোলার আয়োজনে অনেকটা পথ পাড়ি দিচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এতে যে নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে, তা হয়তো বলা যাবে না। নারীকে তার কর্মস্থলে অবস্থান এবং নিজ দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা ভোগ করতে দিতে হবে। সামাজিক কর্মকাণ্ডে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজে নারীর অবদান গুরুত্বহীন হলে প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাক—এই প্রত্যাশা সবার।
- কালের কণ্ঠ
Post a Comment