শিক্ষাক্রম, শিখন ফল ও পাঠ্যসূচি

ইংরেজি কারিকুলাম শব্দটির বাংলা পরিভাষা হিসেবে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম, পাঠক্রম ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে কারিকুলাম শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে শিক্ষাক্রম ব্যবহার করা হয়েছে। কারিকুলাম কথাটি ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হল দৌড়া
নো বা ঘোড়দৌড়ের নির্দিষ্ট পথ। আভিধানিক অর্থে শিক্ষাক্রম বলতে বোঝায়, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একটি কোর্স। বিগত কয়েক দশক ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শিক্ষাক্রম কথাটিকে শিক্ষাবিদরা নানা অর্থে ব্যবহার করছেন। ফলে এর সুনির্দিষ্ট কোনো একক সংজ্ঞা প্রদান করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা আসলে যুগে যুগে লেখকভেদে ক্রমাগত বিবর্তন লাভ করে চলেছে। তাই শিক্ষাক্রমের সর্বজনস্বীকৃত কোনো একক সংজ্ঞার উদ্ভব হয়নি। উন্নত দেশে শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে মূলত ‘কোর্স অব স্টাডি‘কে বোঝানো হতো। শিক্ষাক্রমকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু, কোর্স সীমারেখা, শিক্ষক নির্দেশিকা বা উৎপাদিত সামগ্রী (product) হিসেবে দেখা হতো। শিক্ষাক্রমের এই প্রাচীন ধারণা ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় প্রচলিত ছিল। প্রাচীনকালে জ্ঞান আহরণ করাই ছিল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এ জন্য শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃংখলার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হতো। ১৯৩০ সালের পর থেকে শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয় এবং শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এ সময় শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সব শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বুঝানো হল। ১৯৩৫ সালে ক্যাসওয়েল এবং ক্যাম্পবেল শিক্ষাক্রমের সনাতন ধারণার অবসান ঘটিয়ে আমেরিকায় একটি নতুন সংজ্ঞার প্রস্তাব করেন। তারা বলেন, ‘শিক্ষাক্রম হল শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সব অভিজ্ঞতা।’ অন্যান্য লেখকও ক্যাসওয়েল ও ক্যাম্পবেলের অনুসরণে শিক্ষাক্রমকে ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের প্রভাব প্রকটরূপে দেখা দিল। এর ফলে ষাটের দশকে শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে আমেরিকায় অনেক শিক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু শিক্ষাবিদ শিক্ষাক্রমকে শিখন পরিকল্পনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। এ প্রসঙ্গে টাবা বলেন, 'A Curriculum is a plan for learning.' ষাটের দশকে এবং সত্তরের দশকের প্রথমে অনেকেই স্কুলের কাজকে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। শিল্প-কারখানায় যেমন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে নানারকম দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়, তেমনি স্কুলের কাজ হবে অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এ ধারণা অনুযায়ী স্কুলের সার্বিক ফলাফল, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পারদর্শিতা ও কৃতিত্বের মূল্যায়নের ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এর ফল হিসেবে মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করা এবং স্কুলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকে। ১৯৭০ সালে পোফাম ও বেকার শিক্ষাক্রমকে স্কুলের সেই সব পরিকল্পিত শিখন ফল হিসেবে উল্লেখ করেন, যা অর্জনের দায়দায়িত্ব স্কুলের ওপর বর্তায়। ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ লটন শিক্ষাক্রমের উপাদান নির্বাচনের ব্যাপারে সামাজিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, 'Curriculum is essentially a selection from the culture of a society.' আশির দশকে এসে লক্ষ্য করা যায়, ‘পরিকল্পনা’ ও ‘অভিজ্ঞতা’ ধারণা দু’টিকে সমন্বিত করে শিক্ষাক্রমের একটি সুন্দর সংজ্ঞা রচনা করেছেন দু’জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ- মার্শ ও স্ট্যাফোর্ড। তাদের কথায়-'Curriculum is an interrelated set of plans and experiences which a student completes under the guidance of the school.' শিক্ষাক্রম হল শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের (যেমন- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ইত্যাদি) শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মসূচি সব কিছুই শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে। একটি নির্দিষ্ট বয়স ও শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা কী জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে- তার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল হচ্ছে শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম। কারিকুলাম হচ্ছে সমগ্র শিক্ষা কার্যক্রমের রূপরেখা। কারিকুলামের লক্ষ্য জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় নীতি, জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিবেশ এবং চাহিদা ও উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তার আলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়। এর লক্ষ্য থাকে অনেক ব্যাপক।
এ সব লক্ষ্য অর্জন করার জন্য অনেকগুলো সাধারণ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। এ সব উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে কোন কোন বিষয়বস্তুর মাধ্যমে অর্জন করতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। এখান থেকেই নির্ধারণ করা হয় বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্য। বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যসমূহকে আবার স্তরভিত্তিক উদ্দেশ্যে বিন্যাস করা হয়। অতঃপর স্তরের ওপর ভিত্তি করে বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য নির্ধারণ করা হয় শিখন ফল। একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশিজ ক্ষেত্রসমূহ বিবেচনা করে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও শিখন ফল প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট স্তর অনুযায়ী কী অর্জন করবে- তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনাই হল শিখন ফল। শিখন ফলগুলো হবে সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য ও মূল্যায়নযোগ্য।
পাঠ্যসূচি হল শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। সাধারণত শিক্ষাক্রমের একটি বিশেষ উপাদান বিষয়বস্তু (Content) নিয়ে পাঠ্যসূচি গঠিত হয়। কোনো শ্রেণীতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কী কী বিষয়বস্তু পড়ানো হবে, তারই বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা হল পাঠ্যসূচি। সাধারণত শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষাক্রম পৌঁছায় না। কোনো কোর্সের শুরুতেই পাঠ্যসূচি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে হবে। শিক্ষাক্রমকে একটি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে, পাঠ্যসূচি হবে ওই বৃক্ষের একটি শাখা। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনের বিকাশ সাধন, পক্ষান্তরে পাঠ্যসূচি শিক্ষার্থীর একটি বিশেষ দিকের বিকাশ সাধন করে থাকে। শিক্ষার্থীদের অর্জন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে মূল্যায়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে শিখন-শেখানো কার্যক্রম ও মূল্যায়নে সমকালীন বৈচিত্র্য আনা খুবই জরুরি। বাংলাদেশে বর্তমানে সনাতনী মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে প্রতিটি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন হচ্ছে, যা অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিকে উৎসাহিত করছে। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটবে এবং বাংলাদেশে এই পদ্ধতি দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
মো. মঈনুদ্দিন চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক, শংকুচাইল ডিগ্রি কলেজ, বুড়িচং, কুমিল্লা
mdmoinuddinchowdhury2012@gmail.com

0/Post a Comment/Comments